সিরাজ সিকদার রচনাঃ সমাজতন্ত্র, শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লব প্রসঙ্গে

 

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার

 

 


পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ অক্টোবর ১৯৭২

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ www.sarbaharapath.com এর অনলাইন প্রকাশনা ১৭ আগস্ট ২০১৪


 

পিডিএফ

ভূমিকা

ছয় পাহাড়ের দালাল প্রতিক্রিয়াশীল আওয়ামী লীগ মুজিববাদের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলছে।

মনিসিং-মোজাফফর সংশোধনবাদী, কাজী-রনো-অমলসেন, দেবেন-বাসারও সমাজতন্ত্রের কথা বলছে, একই সাথে মুজিববাদী সমাজতন্ত্রের সাথে একত্মতা ঘোষণা করছে।

রব গ্রুপ (বর্তমানে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) শ্রেণী সংগ্রাম, সামাজিক বিপ্লব ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলছে।

মাওলানা ভাসানী ইসলামিক সমাজতন্ত্রের কথা বলছে।

ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরাও সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলছে।

সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা ও তাদের তাবেদার সংশোধনবাদীরাও সমাজতন্ত্রের কথা বলছে।

এ সকল বিভিন আকৃতির তথাকথিত সমাজতন্ত্রীদের কথাবার্তা ও কার্যকলাপ জনগণের মাঝে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। জনগণের অনেকেই এর ফলে প্রতারিত হচ্ছে।

কাজেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সত্যিকার সমাজতন্ত্র এবং মেকী ও প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা, মেকী ও প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রের ভাওতা উদ্ঘাটন করে জনগণের সামনে তাদের প্রকৃত বিস্বাসঘাতক দালালীর চেহারা তুলে ধরা জরুরী প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

সমাজতন্ত্রের উদ্ভব

ইউরোপে সামন্তবাদী সমাজের মাঝে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা জন্মলাভ করে। এই নতুন উৎপাদন ব্যবস্থার  বিকাশ সামন্তবাদ কর্তৃক প্রতিনিয়ত বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং এক পর্যায়ে সামন্তবাদ উৎখাত ব্যতীত এর বিকাশ অসম্ভব হয়ে উঠে।

তখনই সামন্ততন্ত্র উৎখাতের জন্য বিপ্লব সংগঠিত হয় এবং পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিক ও মালিক (অর্থাৎ বুর্জোয়ার) সৃষ্টি হয়।

শ্রমিকদের চরম দুঃখ–দুর্দশা, সামন্তবাদের দ্রুত পতন এবং ক্ষুদে বুর্জোয়াদের ভেঙ্গে পড়ার প্রক্রিয়ায় প্রথম সমাজতন্ত্রের তত্ত্বের উদ্ভব হয়।

এভাবে ক্ষুদে বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র, সামন্তবাদী সমাজতন্ত্র, সামন্ত সম্ভ্রান্তীয় সমাজতন্ত্রের উদ্ভব হয়। এর পর আসে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীরা।

এরা শ্রমিক এবং সমাজের দরিদ্রদের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে, এটা খারাপ এ কথা বলে, কেউ কেউ পুরোনো সমাজ ভালো এমনি বলে। এ অবস্থার প্রতিকার করার জন্য কেউ কেউ আকাশ কুসুম পরিকল্পনা  করে। কিন্তু এরা কেউই সমাজের এ অবস্থার উদ্ভবের কারণ, এর সমাধানের উপায় খুজে বের করতে পারেনি।

কার্ল মার্কসই সর্বপ্রথম সামাজিক বিকাশের নিয়মাবলী আবিষ্কার করেন, কাল্পনিক সমাজতন্ত্র এবং অন্যান্য সমাজতন্ত্রের ভুল উদ্ঘাটন করেন এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্বর সৃষ্টি করেন। মার্কস ও এঙ্গেলস সারা জীবন কাল্পনিক ও অন্যান্য সকল প্রকার মেকী ও প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রাম করেন, এ সকল তথাকথিত সমাজতন্ত্রের তত্ত্বকে পরাজিত ও কবরস্ত করেন।

সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি

মার্কসের পূর্বেকার সমাজতন্ত্রীদের সমাজতন্ত্র কাল্পনিক ও অবাস্তব হয়েছে, তার কারণ তখনও আধুনিক শিল্প কারখানা ও শ্রমিক শ্রেণী বিকাশ লাভ করেনি। শ্রমিক শ্রেণী তখনো পুঁজিবাদের সারবস্তু বুঝেনি, পুঁজিপতি ও শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যকার শোষণের সম্পর্ক এবং নিজের ঐতিহাসিক দায়িত্ব তারা বুঝেনি।

শ্রমিক শ্রেণী তখন মেশিন-পত্র ভেঙ্গে ফেলতো এবং স্বতস্ফুর্ত সংগ্রাম করতো।

এই পরিস্থিতি সম্পর্কে এঙ্গেলস বলেছেন, এই ঐতিহাসিক অবস্থা সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতাদের নিয়ন্ত্রিত করেছে। পুঁজিবাদী উপাদন ব্যবস্থার অপরিপক্কতা এবং অপরিপক্ক শ্রেণীর অবস্থা (শ্রমিক শ্রেণীলেখক) সাথে খাপ খায় অপরিপক্ক তত্ত্ব (অর্থা কাল্পনিক অবাস্তব সমাজতন্ত্রের তত্ত্বলেখক) [১]

পুঁজিবাদের বিকাশ ও সামন্ততন্ত্রের উপর বিজয়, বিজ্ঞানের বিকাশ, শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠিত ও সচেতন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় শ্রমিক শ্রেণী পুঁজিবাদী সমাজের সারবস্ত বুঝতে পারে, শ্রেণীগুলোর মধ্যকার শোষণের সম্পর্ক এবং নিজের ঐতিহাসিক দায়িত্ব উপলব্ধি করে। মার্কস ও এঙ্গেলস একে সারসংকলন করেন এবং মার্কসবাদের জন্ম দেন।’’ [২]

মার্কস-এঙ্গেলস কাল্পনিক সমাজতন্ত্র ও অন্যান্য বিভিন্ন আকৃতির অবৈজ্ঞানিক, অবাস্তব সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্বের বিজয় প্রতিষ্ঠা করেন।

মার্কসবাদ সমস্ত বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির একমাত্র পথপ্রদর্শক তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হয়। বুর্জোয়া ও তাদের চররা মার্কসবাদকে সরাসরি সংগ্রামে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়ে মার্কসবাদী বনে যায় এবং বুর্জোয়াদের স্বার্থে একে বিকৃত ও সংশোধন করার প্রচেষ্টা চালায়। কমিউনিষ্ট আন্দোলনে এরাই সংশোধনবাদী ও সুবিধাবাদী বলে পরিচিত ।

সংশোধনবাদী ও সুবিধাবাদীদের তথাকথিত সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মার্কসের মৃত্যুর পর এঙ্গেলস সংগ্রাম করেন।

এঙ্গেলসের মৃত্যুর পর সংশোধনবাদীরা প্রায় সকল দেশের শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব দখল করে, সেসকল পার্টিকে বুর্জোয়াদের স্বার্থরক্ষাকারী পার্টিতে পরিণত করে।

মহান লেনিন বুর্জোয়াদের দালাল সংশোধনবাদী ও সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রাম করেন, মার্কসীয় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিকৃতিসমুহ উৎখাত করেন, মার্কসবাদকে রক্ষা ও প্রতিষ্ঠা করেন।

মার্কস পুঁজিবাদের বিকাশের যুগের সমস্যাবলীর সমাধান করেন। পুঁজিবাদ বিকাশ লাভ করে সর্বোচ্চ বিকাশের স্তর সাম্রাজ্যবাদে পৌঁছে। মহান লেনিন এ যুগের সামাজিক বিকাশের নিয়মাবলী আবিষ্কার করেন, সামাজিক বিপ্লবের সমস্যাবলীর সমাধান করন এবং সর্বপ্রথম সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে রাশিয়ায় বল প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন, সর্বহারার একনায়কত্ব কায়েম করেন, পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথমে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন।

এভাবে লেনিন মার্কসবাদকে রক্ষা করেন ও বিকাশ ঘটান এবং লেনিনবাদের স্তরে উন্নীত করেন।

লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিন সুবিধাবাদী ও সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করে  মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পবিত্রতাকে রক্ষা করেন, অনুন্নত কৃষি প্রধান সোভিয়েট ইউনিয়নকে আধুনিক শিল্প প্রধান সোভিয়েট ইউনিয়নে রূপান্তরিত করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদকে কবরস্ত করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মহান গণচীনে সভাপতি মাওসেতুঙের নেতৃত্বে চীনা কমিউনিস্ট  পার্টি ক্ষমতা দখল করে। এশিয়ায় উত্তর কোরিয়া, উত্তর ভিয়েতনাম, ইউরোপের আলবেনিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, যুগোশ্লোভিয়া, হাঙ্গেরি পোল্যান্ড, পূর্বজার্মানী প্রভৃতি দেশে সর্বহারা শ্রেণী ক্ষমতা দখল করে।

এভাবে পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ জনগণ সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পথ গ্রহণ করেন।

স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চোভের নেতৃত্বে আধুনিক সংশোধনবাদীরা [৩] ক্যু-দেতা ঘটিয়ে সোভিয়েট ইউনিয়নের ক্ষমতা দখল করে, সোভিয়েট সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করে, দেশে পুঁজিবাদ পুনপ্রতিষ্ঠা করে, ফ্যাসিবাদী নির্যাতন চালায়, সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টিকে বুর্জোয়া ফ্যাসিস্ট পার্টিতে পরিণত করে।

সোভিয়েট সংশোধনবাদীরা বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা করার প্রতিক্রিয়াশীল প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ সকল দেশের অনেক গুলোতেই তারা পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা এবং তাদেরকে নিজের উপনিবেশে বা নির্ভরশীল দেশে [৪] পরিণত করতে সক্ষম হয়।

তারা বিশ্বের খাঁটি সমাজতন্ত্রী দেশসমুহকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুবিধাবাদী, সংশোধনবাদী ও বুর্জোয়াদের তথাকথিক সমাজতন্ত্রের ভাওতাকে সহায়তা ও রক্ষা করছে।

সভাপতি মাওসেতুঙ আধুনিক সংশোধনবাদী ও সুবিধাবাদীদের মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সংশোধন ও বিকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন, মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে রক্ষা করেন, সাম্রাজ্যবাদের পতনের যুগ এবং সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী যুগের বিপ্লবের সমস্যার সমাধান করেন, মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে মাওসেতুঙ চিন্তাধারার পর্যায়ে উন্নীত করেন।

এ কারণে বর্তমান যুগে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে কে তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ না করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র হতে পারে না।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব ও পথের বিজয় অর্জনের ফলে এ তত্ত্ব ও পথ বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, শ্রমিক-কৃষক-জনগণ একে নিজেদের মুক্তির একমাত্র পথ বলে গ্রহণ করছে।

সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব ও পথের জনপ্রিয়তার সুযোগ গ্রহন করার জন্য সমাতন্ত্রীর সাজ গ্রহণ করেছে শোষক শ্রেণী ও দালালরা, তারা সমাজতন্ত্রের লেবেল এঁটে জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ও ফ্যাসিবাদ চালিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

আওয়ামীলীগ ফ্যাসিস্টরা ছয় দফা কর্মসুচী গ্রহণ করে, পরে স্বাধীনতা আনয়নের নামে দেশকে করে পরাধীন। এর পরে তাদের আর কোন কর্মসুচী নেই।

সমাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তা এবং নিজেদের কর্মসূচীহীনতার কারণে তারা সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়ে জনগণকে প্রতারিত করা এবং নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

তারা জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ও ফ্যাসিবাদ অর্থাৎ মুজিববাদের মাধ্যমে তথাকথিত সমাজতন্ত্র  কায়েমের কথা বলছে। ‘মার্কস যদি মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, লেনিন যদি লেনিনবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, মাওসেতুঙ যদি মাওবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তবে কেন মুজিববাদকে প্রতিষ্ঠা করা যাবেনা এবং এর মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েম করা যাবে না।”—আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টরা এ ধরনের উদ্ভট যুক্তি পেশ করে।

এভাবে মুজিববাদীরা সমাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তার সুযোগ গ্রহণ করে সমাজতন্ত্র কায়েমের নামে সত্যিকার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে ঠেকিয়ে রাখার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

মনিসিং-মোজাফফর সংশোধনবাদীরা মুজিববাদী সমাজতন্ত্রের ভাওতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও তার মুখোশ উন্মোচন করার পরিবর্তে এর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছে।

হক-তোয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন, দেবেন-বাসার, কাজী-রণো সুদীর্ঘ দিন ক্ষুদে বুর্জোয়া সামন্তবাদী সমাজতন্ত্রী মাওলানা ভাসানীর ইসলামিক সমাজতন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করার পরিবর্তে তার লেজুড় বৃত্তি করেছে। তাদের কেউ কেউ মুজিববাদের সাথেও একাত্মতা ঘোষণা করছে।

রবগ্রুপ মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ না করেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলে জনগণকে ভাওতা দিচ্ছে।

এভাবে তারা আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের জনপ্রিয়হীনতা এবং সমাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তার সুযোগ গ্রহণ করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলে ক্ষমতা দখল করা এবং সত্যিকার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে ঠেকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

১৯৫৭ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের সম্মেলন, ১৯৬০ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত ৮০ পার্টির প্রতিনিধিদের সম্মেলনে গৃহীত ঘোষণাপত্রে এ  ধরণের  সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম পরিচালনার আহবান রয়েছে।

আধুনিক সংশোধনবাদী এবং অন্যান্য সংশোধনবাদীরা এ সকল তথাকথিত বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল এবং সাম্রাজ্যবাদের দালাল সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম না করে তাদের রক্ষা করছে ও তাদের লেজুড়বৃত্তি করছে এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতিকতা করছে।

এ সকল তথাকথিত সমাজতন্ত্রীদের তত্ত্বগত ভিত্তি হচ্ছে জনগণকে প্রতারণা করা, সমাজতন্ত্রের  লেবেলের আড়ালে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শোষকদের শোষণ ও লুন্ঠন ন্যায়সঙ্গত করা, তা টিকিয়ে রাখা এবং সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব সম্পর্কে জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা, জনগণের নিকট তা অপ্রিয় করে তোলা, দেশীয়-আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করা।

সামাজিক স্তর ও বিপ্লব

মার্কসবাদ শিক্ষা দেয় সমাজ তার বিকাশের নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী অগ্রসর হয়। সমাজ আদি সাম্যবাদী সমাজ থেকে দাস সমাজে, দাস সমাজ থেকে সামন্তবাদী সমাজে, সামন্তবাদী সমাজ থেকে পুঁজিবাদী সমাজে, পুঁজিবাদী সমাজ থেকে সমাজতান্ত্রিক সমাজে, সমাজতান্ত্রিক সমাজ থেকে কমিউনিস্ট সমাজে, কমিউনিস্ট সমাজ প্রতিনিয়ত কমিউনিজমের উচ্চতর স্তরে বিকাশ লাভ করে।

সামাজিক বিকাশের এই নিয়ম অনুযায়ী সামাজিক বিপ্লবও সংগঠিত হয়।

পূর্ববাংলার সমাজ সামাজিক বিকাশের যে স্তর রয়েছে সে অনুযায়ী বিপ্লব পরিচালিত হবে ইহা মানুষের ইচ্ছার বাইরে বস্তুগত নিয়ম।

পূর্ববাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উপনিবেশিক শোষণ, সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী দেশসমুহের ও তাদের দালালদের শোষণ এবং সামন্তবাদীদের অবশিষ্টাংশের শোষণ বর্তমান।

এ কারণে পূর্ববাংলা হচ্ছে উপনিবেশিক–আধা সামন্তবাদী দেশ অর্থাৎ পূর্ববাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসমাপ্ত রয়ে গেছে।

পূর্ববাংলার সামাজকে পুঁজিবাদী সামাজিক স্তরে পৌছাতে হলে জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালালদের এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সামন্তবাদকে উৎখাত করতে হবে। অর্থাৎ অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সম্পন্ন করতে হবে।

এ কারণে পূর্ববাংলার সমাজের বর্তমান উপনিবেশিক–আধা সামন্তবাদী স্তরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিপ্লব হচ্ছে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব।

এ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে বৈদেশিক শোষণের অবসান অর্থাৎ পূর্ববাংলার বাজারে বৈদেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবসান এবং সামন্তবাদের অবসানের মাধ্যমে বুর্জোয়া বিকাশের শর্ত সৃষ্টি হবে।

এ কারণে জাতীয় গণতান্তিক বিপ্লব হলো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব যার লক্ষ্য হলো পুঁজিবাদ বিকাশে শর্ত সৃষ্টি করা অর্থাৎ সমাজকে পুঁজিবাদী সমাজের স্তরে উন্নীত করা। এ পুঁজিবাদী সমাজের প্রধান দ্বন্দ্ব হচ্ছে বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব (জাতীয় গণতান্তিক বিপ্লবের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শোষকদের সাথে জাতীয় দ্বন্দ্ব এবং দেশীয় সামন্তবাদের সাথে কৃষকের দ্বন্দ্ব সমাধান হয়, ফলে দেশে বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব প্রধান হয়)।

এ পুঁজিবাদী সামাজিক স্তরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ।

এ কারণে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব (পুঁজিবাদকে উৎখাত করার বিপ্লব) সূচনা ও পরিচালনা করা যায়।

সভাপতি মাও বলেছেন, ‘‘গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্তিক বিপ্লব এটা হলো দুটি ভিন্ন প্রকৃতির বিপ্লবী প্রক্রিয়া, শুধুমাত্র প্রথম বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে শেষ করেই দ্বিতীয়টাকে সম্পন্ন করা সম্ভব’’ [৫]

অর্থাৎ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সম্পন্ন করা যায়। একটি দালানের একতলা পার হয়ে দোতলায় উঠা যায়।

পূর্ববাংলার ছয় পাহাড়ের দালাল বুর্জোয়ারা মুজিববাদের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলছে। এর প্রকৃত তাৎপর্য কি?

পূর্ব বাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উপনিবেশিক শোষণ, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এবং আভ্যন্তরীণ সামন্তবাদী শোষণ বর্তমান।

এগুলো উৎখাত না করে সমাজতন্ত্রের কথা বলে ছয় পাহাড়ের দালালরা প্রকৃতপক্ষে পূর্ব বাংলার পরাধীনতা এবং সামন্তবাদী চরিত্রকে টিকিয়ে রাখছে, ছয় পাহাড়ের দালালী করছে।

রবগ্রুপ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলছে।

তারা পূর্ববাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলে মুজিববাদীদের উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করতে চাচ্ছে এবং মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশ স্থাপন, ভারতের মার্কিন সমর্থক অংশের শোষণ টিকিয়ে রাখা এবং পূর্ববাংলার সামন্তবাদীদের শোষণ বজায় রাখতে চাচ্ছে।

জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন না করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করার কথা ট্রটস্কিবাদী বিচ্যুতি। ট্রটস্কিবাদীরা বর্তমান যুগে মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক পরিচালিত। কাজেই পূর্ববাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন না করে সমাজতন্ত্রের কথা বলে রব গ্রুপ প্রমান করছে তারা ট্রটস্কিবাদী এবং মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা পরিচালিত।

পূর্ববাংলা ভারতের উপনিবেশ। এখানে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের শোষণ বর্তমান। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার দালালদের উৎখাত করা, একইসাথে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালালদের উৎখাত করে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার সংগ্রাম অর্থাৎ জাতীয় সংগ্রাম বর্তমানে পূর্ববাংলার প্রধান সংগ্রাম। অর্থাৎ পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জাতীয় ও গণতান্ত্রিক এই দুই দিকের মধ্যে প্রধান দিক হচ্ছে জাতীয় বিপ্লব।

পূর্ববাংলার শ্রমিক-কৃষক-ক্ষুদে বুর্জোয়া জনগণ দেশপ্রেমিক বুর্জোয়া ও দেশপ্রেমিক সামন্তবাদীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় সংগ্রাম করছে। ফলে কৃষকের সাথে দেশপ্রেমিক সামন্তবাদীদের এবং শ্রমিকের সাথে দেশপ্রেমিক বুর্জোয়াদের শ্রেণী সংগ্রাম গৌণ হয়েছে, এ সকল শ্রেণীসমুহের মধ্যে ঐক্য প্রাধান্য পেয়েছে (পাক-সামরিক ফ্যাসিস্ট বিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সময় পূর্ব বাংলার বিভিন্ন দেশপ্রেমিক শ্রেণী ও স্তরসমুহের মধ্যে যেরূপ ঐক্য প্রাধান্য পেয়েছিলো)।

কাজেই শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলে রব গ্রুপ প্রকৃত পক্ষে পূর্ববাংলার জাতীয় সংগ্রামকে বিরোধিতা  করছে, জনগণের দৃষ্টি ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ থেকে সরিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, এদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত পূর্ব বাংলার সমগ্র জাতির ঐক্যকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

এভাবে রবগ্রুপ শ্রেণী সংগ্রামের নামে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদকে টিকিয়ে রাখা অর্থাৎ পূর্ববাংলাকে পরাধীন রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

মনিসিং-মোজাফফর আধুনিক সংশোধনবাদীরা এবং তাদের প্রভু সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা মুজিববাদের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রকে সমর্থন করছে।

অর্থাৎ পূর্ববাংলার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে এ কথা তারা স্বীকার করছে।

এর অর্থ হচ্ছে পূর্ববাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের উপনিবেশিক শোষণ নেই, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এবং মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ নেই এবং অভ্যন্তরে সামন্তবাদী শোষণ নেই।

ইহা প্রমাণ করে তারা বৈদেশিক শোষক এবং তাদের দেশীয় দালাল ও সামন্তবাদীদের দালালী করছে। তারা জাতীয় বিশ্বাসঘাতক এবং সামন্তবাদের তল্পিবাহক।

এ কারণে তারা আওয়ামী লীগের দালাল। জনগণ সঠিকভাবেই তাদেরকে “বি’’ টিম বলে আখ্যায়িত করে।

কাজী-রনো এবং দেবেন-বাসার সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতা অর্থাৎ মুজিববাদের সাথে অর্থাৎ জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ও ফ্যাসিবাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে জাতীয় গণতান্তিক বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার তত্ত্বকেই মেনে নিয়েছে (যদিও বর্তমানে তারা জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন না হওয়ার কথা বলছে)।

জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সংগ্রামের পদ্ধতি

জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শান্তিপূর্ণ উপায়ে না বলপ্রয়োগের  মাধ্যমে হবে এ নিয়ে মার্কসবাদের আবির্ভাবের সময় থেকেই সুবিধাবাদী, সংশোধনবাদী সাম্রাজ্যবাদের তাবেদারদের সাথে সর্বহারা বিপ্লবীদের জীবন-মরণ সংগ্রাম চলেছে।

সাম্রাজ্যবাদের দালাল বুর্জোয়ারা জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপোষ করে শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনার কথা বলে।

পাক ভারতের বুর্জোয়ারা বৃটিশ উপনিবেশবাদীদের সাথে আপোষ করে অহিংস পথে দেশ স্বাধীন করার (প্রকৃতপক্ষে নতুন করে পরাধীন করার) কথা বলে।

এর পরিণতি হয় স্বাধীনতার পরিবর্তে নতুন করে পরাধীনতা, উপনিবেশের পরিবর্তে পাক-ভারত হয় নয়া উপনিবেশ বা আধা উপনিবেশ।

সংশোধনবাদীরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে পার্লামেন্টের মাধ্যমে জাতীয় গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনার কথা বলে।

পক্ষান্তরে মার্কসবাদীরা বলে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ছাড়া সম্ভব নয়।

সভাপতি মাও বলেছেন, বিপ্লব ও বিপ্লবী যুদ্ধ শ্রেণী সমাজে অবশ্যম্ভাবী এবং তাদের ব্যতীত সামাজিক বিকাশের দ্রুত অতিক্রমন সম্পন্ন করা এবং প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণীকে উখাত করা অসম্ভব; অতএব জনগণের পক্ষে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা অসম্ভব। [৬]

সংশোধনবাদীরা বিপ্লবী যুদ্ধকে পরিহার করে বুর্জোয়াদের লেজুড়ে পরিণত হয়। মনিসিং–মোজাফফর সংশোধনবাদীরা ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়ার নির্বাচনী কাঠামোর অধীনে নির্বাচনের কানাগলিপথে অগ্রসর হয়। এ পথে দেউলিয়াত্ব প্রমানিত হলে তারা অহিংস–অসহযোগের ভুল পথ গ্রহণ করে, শেষ পর্যন্ত পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের প্রচণ্ড সামরিক হামলার মুখে ভারতে পলায়ন করে।

ভারতে তারা জাতীয় বিশ্বাসঘাতক ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করে, তারা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের পদলেহী কুকুরে পরিণত হয় এবং ভাড়াটে বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়, পূর্ববাংলাকে তারা ভারতের নিকট বিকিয়ে দেয়।

শেষ পর্যন্ত ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে ডেকে এনে পূর্ববাংলাকে তার হাতে তুলে দেয়।

এভাবে সোভিয়েট আধুনিক সংশোধনবাদী এবং তার দালাল মনিসিং-মোজাফফর সংশোধনবাদীদের শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লব করার তত্ত্ব সম্পুর্ণ দেউলিয়া বলে প্রমানিত হয়। শান্তিপূর্ণ উপায়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব দূরের কথা জাতীয় প্রতিবিপ্লবও ঘটানো পূর্ব বাংলার ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি (অর্থাৎ ভারত কর্তৃক শান্তিপূর্ণভাবে পূর্ববাংলা দখল সম্ভব হয়নি)।

বর্তমানে তারা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে পার্লামেন্টের মাধ্যমে তথাকথিত সমাজতন্ত্র কায়েমের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

আধুনিক সংশোধনবাদীরা পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী দেশে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে বা পার্লামেন্ট ও বাইরের গণসংগ্রামের চাপের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল ও সমাজতন্ত্র আনয়ন বা রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন করে সমাজতন্ত্র আনয়নের রঙিন স্বপ্ন দেখছে। [৭]

প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী বুদ্ধু নয়, তারা হাঁটু গেড়ে হাতজোড় করে কখনও শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না।

তাদের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা শেষ পর্যন্ত প্রচেষ্টা চালাবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। এ উদ্দেশ্যে তারাই প্রথম বলপ্রয়োগ করবে।

কাজেই সর্বহারার আর কোন পথ নেই এই সামরিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা, প্রথমতঃ সামরিক বাহিনীকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করা ব্যতীত।

ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি সূকর্ণের মাধ্যমে (বুর্জোয়ার মাধ্যমে) জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা দখলের সংশোধনবাদী পথ অনুসরন করেছিলো।

তার পরিণতি হিসাবে কয়েক লক্ষ কমিউনিস্ট এবং দেশপ্রেমিক বিপ্লবী প্রাণ হারায়, ইন্দোনেশীয় বিপ্লবের মারাত্মক ক্ষতি হয়।

আধুনিক সংশোধনবাদীরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং বুর্জোয়াদের মাধ্যমে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব এমনকি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা করার কথা বলে সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, সর্বহারা শ্রেণীকে অপ্রস্তুত রাখছে, বুর্জোয়াদের টিকিয়ে রাখছে। আধুনিক সংশোধনবাদীরা প্রকৃতপক্ষে বুর্জোয়াদের দালালী করছে।

রব গ্রুপ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লবের কথা বলছে কিন্তু পার্লামেন্টারী নির্বাচনের কানা গলি পথে অগ্রসর হচ্ছে। এরা সশস্ত্র সংগ্রামকে অস্বীকার করছে।

কাজী-রনো, আমল সেন, দেবেন-বাসাররা সশস্ত্র সংগ্রামকে বিরোধিতা করছে, মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ গ্রহনের কথা বলছে, নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম করার দাসখত দিয়ে প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের জোয়ালবদ্ধ হয়েছে।

এ সকল সংশোধনবাদী ও বিশ্বাসঘাতকদের পথ বর্জন করে পূর্ববাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।

জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এই মহান সশস্ত্র সংগ্রাম গণযুদ্ধের রণনীতি ও রণকৌশল অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে, গ্রাম দখল করে শহর ঘেরাও করতে হবে, শেষ পর্যন্ত শহর দখল করে সমগ্র পূর্ব বাংলা মুক্ত করতে হবে।

পূর্ববাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে পরিচালিত হলেই শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রের উত্তরণের সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে।

জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে সম্পন্ন হওয়ার অর্থ হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছে, রাষ্ট্রযন্ত্রের মালিকানা প্রধানতঃ সর্বহারা  শ্রেণী অর্জন করেছে। শক্তির ভারসাম্য সর্বহারার পক্ষে এসেছে, ফলে বুর্জোয়ারা বাধ্য হবে সর্বহারা শ্রেণীর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচী মেনে নিতে।

কাজেই জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে অর্জন করা অব্যাহতভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনার জন্য অপরিহার্য।

চীন, উত্তর কোরিয়া, উত্তর ভিয়েতনামে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আভ্যন্তরীণ বুর্জোয়াদের সাথে সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যতিরেকেই শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিচালনা সম্ভব হয় (কোরিয়া বাইরের সাম্রাজ্যবাদী হামলার মোকাবেলা করে, ভিয়েতনাম এখনও হামলার মোকাবেলা করছে)।

শ্রেণী সংগ্রাম, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ও সর্বহারার একনায়কত্ব

মার্কসবাদের জন্মলগ্ন থেকেই সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা ও তা টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন নিয়ে মার্কসবাদীদের সাথে সংশোধনবাদী, সুবিধাবাদী ও বুর্জোয়াদের জীবন মরণ সংগ্রাম চলে। সর্বহারার একনায়কত্বের প্রশ্ন নিয়ে পূর্ববাংলার মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের সাথে সংশোধনবাদী, সুবিধাবাদী, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুদের দালালদের প্রচণ্ড সংগ্রাম চলছে।

রবগ্রুপ শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলছে। কিন্তু তারা সর্বহারার একনায়কত্বের কথা বলছে না।

মুজিববাদীরা সমাজতন্ত্র কায়েম হয়েছে বলে দাবী করছে, কিন্তু সর্বহারার একনায়কত্বের কথা বলছে না।

মনিসিং-মোজাফফর সংশোধনবাদী, কাজি-রণো-অমলসেন, দেবেন-বাসার সংশোধনবাদীরা সর্বহারার একনায়কত্বকে বাদ দিয়ে সমাজতন্ত্রের কথা বলছে।

মাওলানা ভাসানীও সর্বহারা একনায়কত্বের কথা বলছে না।

সোভিয়েত আধুনিক সংশোধনবাদীদের নেতৃত্বে বিশ্বের আধুনিক সংশোধনবাদীরা সর্বহারার একনায়কত্বকে বিসর্জন দিয়েছে।

এ সকল তথাকথিত সমাজতন্ত্রীরা যতই শ্রেণী সংগ্রাম, সামাজিক বিপ্লব ও সমাজতন্ত্রের গলাবাজি করুক না কেন এদের সমাজতন্ত্র হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীলদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা ও টিকিয়ে রাখা।

এর কারণ রাষ্ট্র হচ্ছে এক শ্রেণী কর্তৃক অন্য শ্রেণীকে দাবিয়ে রাখার যন্ত্র মাত্র। এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীর উপর এর মাধ্যমে একনায়কত্ব চালায়। কাজেই এ রাষ্ট্র সর্বহারার একনায়ত্ব না হলে অবশ্যই বুর্জোয়া বা প্রতিক্রিয়াশীলদের একনায়কত্বমূলক হবে।

এ কারণেই লেনিন বলেছেন, “এটা প্রায় বলা এবং লেখা হয় যে মার্কসের তত্ত্বের সারবস্তু হলো শ্রেণী সংগ্রাম, এটা সত্য নয়। এ মিথ্যা থেকে প্রায়ই বেরিয়ে আসে মার্কসবাদের সুবিধাবাদী বিকৃতি, একে মিথ্যা করে বুর্জোয়াদের নিকট গ্রহণীয় করে তোলা। কারণ শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব মার্কস কর্তৃক সৃষ্ট নয়। মার্কসের পূর্বে বুর্জোয়ারাই ইহা সৃষ্টি করেছে। সাধারণভাবে ইহা বুর্জোয়াদের নিকট গ্রহণীয়। যারা শুধু শ্রেণী সংগ্রামকে স্বীকার করে তারা এখনও মার্কসবাদী হয়নি। তারা এখনও বুর্জোয়া চিন্তা এবং বুর্জোয়া রাজনীতির আওতায় রয়ে গেছে। মার্কসবাদকে শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বে সীমাবদ্ধ রাখার অর্থ হল মার্কসবাদকে খর্ব করা, বুর্জোয়াদের নিকট গ্রহণীয় এরূপ বিষয়ে রূপান্তরিত করা। কেবলমাত্র সে-ই একজন মার্কসবাদী যে, শ্রেণী সংগ্রামের স্বীকৃতিকে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের স্বীকৃতিতে প্রসারিত করে। এটাই হচ্ছে মার্কসবাদী এবং সাধারণ ক্ষুদে বুর্জোয়া (বড় বুর্জোয়াও)–দের মধ্যকার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য।” [৮]

মার্কস নিজেই বলেছেন, “আধুনিক সমাজে শ্রেণীর বা তাদের মধ্যকার সংগ্রামের অস্তিত্ব আবিষ্কারের জন্য আমার কোন কৃতিত্ব পাপ্য নয়। আমার বহু পূর্বেই বুর্জোয়া ঐতিহাসিকরা শ্রেণী সমূহের সংগ্রামের ইতিহাসের বিকাশ সম্পর্কে বর্ণনা করেছে, বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা শ্রেণীসমুহের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ দিয়েছে। আমার নতুন অবদান হচ্ছে যে আমি প্রমাণ করেছিঃ ১) শ্রেণী সমূহের অস্তিত্ব উৎপাদনের বিকাশের বিশেষ ঐতিহাসিক স্তরের সাথে জড়িত। ২) শ্রেণী সংগ্রামের অনিবার্য গতি হবে সর্বহারার একনায়কত্বে। ৩) এই একনায়কত্ব হচ্ছে সকল শ্রেণীকে বিলুপ্ত করার এবং শ্রেণীহীন সমাজে প্রবেশ করার উত্তরণ মাত্র।” [৯]

কাজেই শ্রেণী সংগ্রামের কথা বললেই মার্কসবাদী হওয়া যায় না। শ্রেণী সংগ্রামের স্বীকৃতিকে সর্বহারা স্রেণীর একনায়কত্বের স্বীকৃতিতে প্রসারিত করতে হবে।

সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের মতবাদ কাল্পনিক এবং বুর্জোয়া ও প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রের সাথে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মৌলিক পার্থক্য রেখা টানছে।

কাজেই রব গ্রুপ শ্রেণী সংগ্রাম, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বললেও তারা সমাজতন্ত্রের বেশে মার্কিনের দালাল, মুজিববাদীরা সমাজতন্ত্রীর বেশে ছয় পাহাড়ের দালাল।

ভাসানী ইসলামিক সমাজতন্ত্রের নামে ক্ষুদে বুর্জোয়া সামন্তবাদী সমাজতন্ত্রী।

মনিসিং-মোজাফফর সংশোধনবাদীরা ও তাদের প্রভু সোভিয়েট আধুনিক সংশোধনবাদীরা, কাজী-রনো-অমলসেন, দেবেন-বাসাররা সর্বহারার একনায়কত্বকে বিসর্জন দেয়ে সমাজতন্ত্রের কথা বলে প্রমাণ করছে তারা মার্কসবাদীর বেশে সংশোধনবাদী।

৭। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর্যায়ে রাষ্ট্রের চরিত্র

রাষ্ট্র হচ্ছে এক শ্রেণী কর্তৃক অন্য শ্রেণী দাবিয়ে রাখার যন্ত্র মাত্র। অর্থাৎ শ্রেণী নিপীড়নের যন্ত্র।

শ্রেণী সমাজের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। এক শ্রেণী কর্তৃক অন্য শ্রেণীর উপর একনায়কত্ব পরিচালনার যন্ত্র হচ্ছে রাষ্ট্র।

পূর্ববাংলার রাষ্ট্রের মালিক হলো ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ এবং পুর্ববাংলার সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের প্রতিনিধিরা। এরাও রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে পূর্ববাংলার জনগণের উপর ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব পরিচালনা করছে।

এ রাষ্ট্রকে মনিসিং–মোজাফফর সংশোধনবাদীরা জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে স্বাগত জানাচ্ছে, এমনকি তারা মুজিববাদের ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রের ভাওতাকে এবং সংবিধানকে স্বাগত জানাচ্ছে।

আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীদের প্রতিনিধিরা সামরিক আমলতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে শোষণ ও লুন্ঠন এবং ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব পরিচালনা করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করছে বলে মনিসিং-মোজাফফর সংশোধনবাদীরা বিশ্বাস করছে।

মার্কসবাদকে এরা কতখানি বিসর্জন দিয়েছে!

জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রাধানতঃ সেনাবাহিনীকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র, প্রধানতঃ সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে হবে এবং জনগণের যৌথ গণতান্ত্রিক একনায়কত্বমূলক রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে।

পূর্ব বাংলার এই নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র বৈদেশিক শোষকদের দালাল এবং সামন্তবাদীদের দাবিয়ে রাখার এবং বৈদেশিক আক্রমন প্রতিহত করার জন্য ব্যবহৃত হবে।

জনগণের এই যৌথ গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব হবে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে সকল দেশপ্রেমিক শ্রেণীর যৌথ একনায়কত্ব।

এই যৌথ একনায়কত্বের কারণ হলো জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সময় কৃষক, ক্ষুদে বুর্জোয়া এমনকি জাতীয় বুর্জোয়ারাও অংশ গ্রহণ করে।

এ কারনে এ একনায়কত্বকে সভাপতি মাও বলেছেন, ‘জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব।’

জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব জনগণের মাঝে গণতন্ত্র নিশ্চিত করে, শত্রুদের উপর একনায়কত্ব পরিচালনা করে।

জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্বে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব প্রমাণ করছে ইহা সর্বহারার একনায়কত্বের একটি রূপ।

পক্ষান্তরে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র হবে সর্বহারার একনায়কত্বমুলক।

৮। শ্রেণীসংগ্রাম, সামজিক বিপ্লব ও সর্বহারার একনায়কত্বে সর্বহারা শ্রেণীর ভূমিকা

রব গ্রুপ শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লবের কথা বলছে। কিন্তু সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বের কথা বলছে না।

বর্তমান যুগে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব ব্যতীত শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লব সঠিক পথে পরচালনা ও সম্পন্ন করা শুধু যে অসম্ভব তাই নয়, শ্রেণী আপোষ ও সামাজিক প্রতিবিপ্লব ঘটার সম্ভাবনা থাকে।

সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের পর বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়। কারণ বুর্জোয়ারা শ্রেণীগতভাবে দুর্বল, এ কারণে তারা সহজেই সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা ক্রীত হয়ে তাদের তাবেদারে পরিণত হয় এবং দোদুল্যমানতা দেখায়।

পাক-ভারতের বুর্জোয়ারা স্বাধীনতা আন্দোলন করে, কিন্তু বৃটিশের সাথে আপোস করে স্বাধীনতা আনয়ন করলেও বৃটিশ ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষা করে তাদের পরোক্ষ লুন্ঠন ও শোষণ  বজায় রাখে।

এভাবে সরাসরি উপনিবেশ থেকে পাক-ভারত আধা উপনিবেশে পরিণত হয়। সামন্তবাদের সাথেও তারা আপোস করে এবং তাকে টিকিয়ে রাখে। এ কারণে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসমাপ্ত রয়ে যায়।

এ কারণে বর্তমান যুগে বুর্জোয়া নেতৃত্ব বুর্জোয়াদের নিজেদের বিকাশের জন্য অপরিহার্য জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবও সম্পন্ন করতে পারে না।

পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া নেতৃত্ব জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অর্থাৎ সামাজিক বিপ্লব পরিচালনা করতে যেয়ে সামাজিক প্রতিবিপ্লব ঘটায়, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের নিকট নিজেদের বাজার লিখে দিয়ে নিজেদের বিকাশের পথে কুড়োল মারে, নিজেদের শ্রেণীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।

এর কারণ কি? কারণ নিজেদের শ্রেণীগত দুর্বলতা।

তারা টাটা-রমলা-বিরালার সমান হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভয়ে কখনও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের অভ্যর্থনা জানাতো না।

কাজেই বর্তমান যুগে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব ব্যতীত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব, শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লব পরিচালনা করা সম্ভব নয়।

শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামের সর্বোচ্চ রূপ হচ্ছে শ্রেণী ও জাতীয় যুদ্ধ।

ইহাও সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব ব্যতীত সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে না। বুর্জোয়া নেতৃত্বে শ্রেণী ও জাতীয় আপোস অথবা শ্রেণী ও জাতীয় প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধে পরিণতি লাভ করে।

আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টরা পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের হামলা মোকাবেলার কোন পরিকল্পনাই করেনি। স্বতস্ফূর্তভাবে তারা ভূল পথে কিছুটা প্রতিরোধ চালায়। শেষ পর্যন্ত তাও ভেঙ্গে পড়লে তারা আত্মরক্ষার্থে ভারতে পলায়ন করে, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের কামানের খোরাকে পরিণত হয়। যুদ্ধকে প্রতিবিপ্লবী জাতীয় পরাধীনতার যুদ্ধে পরিণত করে। তারা সর্বদাই এ যুদ্ধে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বের শুধু যে বিরোধিতা করেছে তাই নয়, এমনকি তাদেরকে খতম করার কাজকে প্রাধান্য দিয়েছে।

এভাবে লক্ষ লক্ষ জনগণের রক্তের বিনিময়ে পরিচালিত যুদ্ধ ব্যর্থ হয়। এ কারণেই সভাপতি মাও বলেছেন (বর্তমান যুগে) “ ………… যে কোন বিপ্লবী যুদ্ধে সর্বহারা শ্রেণী ও ……… (তার রাজনৈতিক পার্টির—লেখক) নেতৃত্বের অভাব ঘটলে অথবা সেই নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গেলে সে যুদ্ধ অনিবার্যভাবেই ব্যর্থ হবে।’’ [১০]

‘শ্রেণী সংগ্রাম, শ্রেণী ও জাতীয় যুদ্ধ, সামাজিক বিপ্লব ও সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব অপরিহার্য কারণ কেবল মাত্র সর্বহারা শ্রেণীই হচ্ছে সবচেয়ে বেশী দুরদর্শী, নিস্বার্থ এবং চুড়ান্তভাবে বিপ্লব চালতে সবচেয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সমগ্র বিপ্লবের ইতিহাস প্রমাণ করে, শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব ছাড়া বিপ্লব ব্যর্থ হয় আর শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব থাকলেই বিপ্লব জয়লাভ করে।” [১১]

তিনি আরও বলেছেন, ………… শুধু মাত্র সর্বহারা শ্রেণী… …(সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টিলেখক)হচ্ছে সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতা থেকে সবচেয়ে মুক্ত, রাজনীতিগতভাবে তারাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশী দুরদৃষ্টি সম্পন্ন ও সবচেয়ে বেশী সংগঠিত, আর দুনিয়ার অগ্রগামী সর্বহারা শ্রেণী ও তার রাজনৈতিক পার্টিরগুলোর অভিজ্ঞতাকে তারা সবচেয়ে বেশী বিনয়ের সাথে গ্রহণ করতে এবং সে অভিজ্ঞতাকে নিজেদের কার্যে প্রয়োগ করতে পারে। তাই কেবল মাত্র সর্বহারা শ্রেণী ও কমিউনিস্ট পার্টিই কৃষক, শহুরে ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী ও বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্ব দিতে পারে, কৃষক ও ক্ষুদে বুর্জোয়াদের সংকীর্ণতাকে, বেকারদের ধ্বংসাত্মকতাকে অতিক্রম করতে পারে। আর বুর্জোয়া শ্রেণীর দোটানা মনোভাবকেও, শেষ পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাবার মনোবলের অভাবকেও অতিক্রম করতে পারে (অবশ্য যদি কমিউনিস্ট পার্টির নীতিতে ভুল না হয়) এবং বিপ্লব ও যুদ্ধ বিজয়ের পথে এগিয়ে নিতে পারে।” [১২]

সর্বহারার নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অবশ্যই পরিচালিত হতে হবে। ইহা বর্তমান যুগের  সামাজিক বিকাশের একটি ইচ্ছামুক্ত বস্তুগত নিয়ম।

সর্বহারার নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সভাপতি মাও নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করছেন (এর বিপরীতে বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব হলো পুরোনো গণতান্ত্রিক বিপ্লব যার পরিণতি হচ্ছে উপনিবেশিক বা আধা উপনিবেশিক, সামন্তবাদী বা আধা সামন্তবাদী দেশ)।

এ বিপ্লবে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব থাকার অর্থ হলো সামাজিক বিকাশের গতি বজায় থাকা অর্থাৎ পরিপূর্ণরূপে সম্প্রসারণবাদী, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এবং সামন্তবাদী শোষণের অবসান অর্থাৎ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হওয়া।

এ বিপ্লব সম্পন্ন করেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা করা সম্ভব।

অন্য কথায়, “সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব সমগ্র বিপ্লবের (জাতীয় গণতান্ত্রিক—লেখক) চেহারাটাই পাল্টে দেয়, শ্রেণীসমূহকে নতুন ভাবে সন্নিবেশিত করে, কৃষকদের বিপ্লবে প্রচণ্ড জোয়ার আনে, সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী বিপ্লবে সম্পূর্ণতা আনে, গণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে উত্তরণের সম্ভবনার সৃষ্টি করে”। [১৩]

এভাবে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সর্বহারার বিপ্লবের সাথে যুক্ত করে।

মনিসিং–মোজাফফর সংশোধনবাদীরা সামাজিক বিপ্লবের নিয়মকে সংশোধন করে বলে, ‘উৎপাদক শক্তি অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণী যথেষ্ট পরিমানে বিকাশ লাভ না করা পর্যন্ত বুর্জোয়া গণতান্তিক বিপ্লবে বুর্জোয়াদের নেতৃত্ব মিনে নিতে হবে’’।

এ কারণেই তারা স্বেচ্ছায় পূর্ববাংলার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব বুর্জোয়াদের অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টের হাতে তুলে দেয়। এ প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব থেকেই আসে আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের নেতৃত্ব মেনে চলা অর্থাৎ তাদের লেজূড়বৃত্তি করার বিশ্বাসঘাতক যুক্তি।

‘উৎপাদক শক্তির যথেষ্ট বিকাশ না হওয়া পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করা যায় না’ এ যুক্তি দেখিয়ে মনিসিং–মোজাফফর সংশোধনবাদীরা আওয়ামীলীগ ফ্যাসিস্ট জাতীয় বিশ্বাসঘাতিক সরকারের লেজুড়বৃত্তি করছে, তাদেরকে উৎপাদক শক্তি অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণী সৃষ্টি করার সুযোগ দিচ্ছে।

কি বিশ্বাসঘাতক যুক্তি!

ছয় পাহাড়ের দালাল আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টরা বৈদেশিক শোষণ ও লুন্ঠন বজায় রাখছে, পূর্ববাংলাকে ভারতের উপনিবেশে পরিণত করেছে, সামন্তবাদী শোষণ জিইয়ে রেখেছে অর্থাৎ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসম্পন্ন রেখেছে, পূর্ববাংলাকে নতুন করে উপনিবেশিক আধা-সামন্তবাদী পূর্ববাংলায় রূপান্তরিত করছে। কাজেই এখানে বুর্জোয়া বিকাশ এবং এর বিপরীতে শ্রমিক শ্রেণীর বিকাশ কি করে সম্ভব?

মনিসিং-মোজাফফর সংশোধনবাদীরা বিশ্বাসঘাতকতা করতে করতে মার্কসবাদের ক খ গ-ও ভুলে গেছে।

সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে পরিচালিত ও সম্পন্ন জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কালে রাষ্ট্র হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে অন্যান্য দেশপ্রেমিক শ্রেণীর যৌথ একনায়কত্ব মূলক রাষ্ট্র। ইহা সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বেরই একটি রূপ।

সমাজতান্ত্রিক সমাজে রাষ্ট্র হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বমূলক রাষ্ট্র।

সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব পরিচালনার জন্য সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব অপরিহার্য। সভাপতি মাও বলেছেন, জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের জন্য সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব প্রয়োজন [১৪]

“সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির মাধ্যমে পদত্ত হয়। এ রাজনৈতিক  পার্টি গঠিত হয় সর্বহারা শ্রেণীর সবচাইতে অগ্রগামী ব্যক্তিদের দ্বারা, ইহা হবে একটি সজীব প্রাণ শক্তিতে ভরপুর অগ্রগামী সংগঠন যা সর্বহারা শ্রেণী ও বিপ্লবী জনগণকে শ্রেণী (এবং জাতীয়—লেখক) শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পরিচালনায় সক্ষম।’’ [১৫]

এ পার্টির পথ প্রদর্শক তাত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা।

রব গ্রুপ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার ভিত্তিতে পরিচালিত সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব ব্যতীত শ্রেণী সংগ্রাম, সামাজিক বিপ্লব করা এবং সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলছে।

সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব ব্যতীত শ্রেণী সংগ্রাম, সামাজিক বিপ্লব করা ও সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলার অর্থ হচ্ছে বুর্জোয়া ও প্রতিক্রিয়াশীলদের নেতৃত্বে সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লব করা এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।

এভাবে রব গ্রুপ সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব বাদ দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের নেতৃত্বের কথা বলছে, এর পরিণতি হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামের নামে শ্রেণী আপোস, সামাজিক বিপ্লবের নামে সামাজিক প্রতিবিপ্লব এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার তাবেদারেদের  শোষণ ও লুন্ঠন এবং  ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

মনিসিং–মোজাফফর সংশোধনবাদীরা এবং কাজী-রনো-অমলসেন, দেবেন-বাসার এবং দেশীয়–আন্তর্জাতিক অন্যান্য সংশোধনবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার ভিত্তিতে পরিচালিত সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব ব্যতীত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব, শ্রেণী সংগ্রাম, সামাজিক বিপ্লব করা, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে দেশীয় আন্তর্জাতিক শোষণ ও লুন্ঠন এবং ফ্যাসিস্ট একনায়কত্বকে সহায়তা করছে।

পূর্ববাংলার ঘটনাবলী প্রমাণ করছে পূর্ববাংলার জনগণের মুক্তির সংগ্রামে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার ভিত্তিতে পরিচালিত সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির পরিবর্তে প্রতিক্রিয়াশীলদের নেতৃত্বের পরিণতি হচ্ছে আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের অনুরূপ জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা, ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব, দেশীয় আন্তর্জাতিক শোষণ ও লুন্ঠনের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।

জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অর্থনীতি

জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব হচ্ছে বৈদেশিক বুর্জোয়দের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং আভ্যন্তরীণ সামন্তবাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দূর করে বুর্জোয়া বিকাশের শর্ত সৃষ্টির বিপ্লব।

এ কারণে এ বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগত মালিকানা রক্ষা করা হবে এবং বৈদেশিক পুঁজি, বিদেশের সাথে যুক্ত পুঁজি রাষ্ট্রীয়করণ করতে হবে এবং সামন্তবাদকে পুরোপুরি উৎখাত করে ভূমিহীন কৃষকের মাঝে ভূমি বিতরণ করতে হবে।

বাংলাদেশ পুতুল সরকার সমাজতন্ত্রের কথা বলছে, কিন্তু এখনো জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবই সম্পন্ন করেনি।

তারা কোন সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি এবং তাদের সাথে যুক্ত পুঁজিকে বাজেয়াপ্ত করেনি। তারা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি অবাধে অনুপ্রবেশ করতে দিচ্ছে, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী লুন্ঠন বজায় রাখছে, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী লুন্ঠন চলতে দিচ্ছে, তারা সামন্তবাদকে উৎখাত করেনি।

এভাবে পূর্ববাংলা উপনিবেশিক-আধা সামন্তবাদী রয়ে গেছে (মনিসিং–মোজাফফর  বিশ্বাসঘাতকরা একে অস্বীকার করছে)।

সমাজতান্ত্রিক সমাজে ভূমিকে সমবায় প্রথা, শেষ পর্যন্ত কমিউনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত মালিকানা থেকে সামাজিক মালিকানায় রূপান্তরিত করা হয়।

উৎপাদন (কল-কারখানা, শিল্প) এবং বন্টন (দোকান, পাইকারী খুচরা) এবং পরিবহনসহ সকল বিষয় ব্যক্তিগত মালিকানা থেকে রাষ্টীয় মালিকানায় আনা হয়।

মানুষ তার সাধ্যমত কাজ করে, কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পায়।

এ অর্থনৈতিক অবস্থায় মানুষ কর্তৃক মানুষ শোষণ অর্থাৎ শ্রমিক-কৃষকের উদ্বৃত্ত শ্রম মালিকের পকেটস্থ হওয়া বাতিল হয়।

শ্রমিক-কৃষক, বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য কর্মচারীরা তাদের শ্রম দ্বারা তৈরী উদ্বৃত্ত মূল্যের এক অংশ পায়, বাকী অংশ রাষ্ট্র ব্যবহার করে তাদের কল্যাণে সমাজের উন্নতির মূলধন হিসেবে।

পূর্ববাংলার ছয় পাহাড়ের দালালরা সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলছে, কিন্তু সর্বস্তরে ব্যক্তিমালিকানা এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ব কল-কারখানায় আমলাদের মালিকানা, বিদেশী পুঁজির মালিকানা বজায় রেখেছে।

কাজেই অর্থনৈতিক দিক দিয়েও এ সরকার সমাজতন্ত্রী দূরের কথা জাতীয় গণতন্ত্রীও নয়।

১০। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সামাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রাজনীতি

জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় সর্বহারা শ্রেণীকে অবশ্যই বিপ্লবের নেতৃত্ব অর্জন করতে হবে, বুর্জোয়াদের দোদুল্যমানতাকে তুলে ধরতে হবে, তাদের সাথে ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি গ্রহণ করতে হবে। নিজের স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে হবে, কোন অবস্থায় বুর্জোয়াদের লেজুড়ে পরিণত হলে চলবে না।

বুর্জোয়াদের লেজুড়ে পরিণত হওয়ার অর্থ হবে বুর্জোয়াদের স্বার্থের সেবা করা, বিপ্লবের ক্ষতি করা, সর্বহারা ও জনগণের রক্তপাতকে বৃথা যেতে দেওয়া।

মনিসিং–মোজাফফর সংশোধনবাদীরা নিজেদের স্বতন্ত্র ভূমিকা বিসর্জন দিয়ে, বুর্জোয়াদের লেজুড়ে পরিণত হয়।

ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব বুর্জোয়াদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে, স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্রতা বিসর্জন দেয়। এর পরিণতি হিসেবে তাদের লক্ষ লক্ষ কমরেডকে প্রাণ দিতে হয়।

মনিসিং-মোজাফফর সংধোধনবাদীরাও কি একই ভাবে বুর্জোয়াদের লেজুড় হয়ে নিজেদের কবর রচনা করছে না?

সর্বহারা শ্রেণী অবশ্যই কৃষক-শ্রমিক মৈত্রী গড়ে তুলবে, ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ করবে, বুর্জোয়াদের সাথে ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি গ্রহণ করবে।

এ কারণে তাদেরকে গ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করতে হবে, কৃষকদের শত্রু সামন্তবাদীদের উৎখাত করে কৃষকদের মুক্ত করতে হবে, তাদেরকে এভাবে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে নিয়ে আসতে হবে।

সমাজতান্ত্রিক সমাজে বুর্জোয়াদের পুনরায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল ঠেকানো প্রধান সমস্যা।

এ কারণে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত শ্রেণী সংগ্রাম চালতে হবে, সর্বহারার একনাকত্বকে জোরদার করতে হবে।

সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের অধীন সর্বহারার সাংস্কৃতিক বিপ্লব পরিচালনা করতে হবে।

১১। সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম

মুজিববাদী ও রব গ্রুপ সমাজতন্ত্র, শ্রেণীহীন সমাজ প্রভৃতির কথা বলে। সমাজতন্ত্রিক সমাজে শ্রেণী ও শ্রেণী সংগ্রাম থাকবে।

এ কারণে সমাজতান্ত্রিক সমাজে সর্বহারার একনায়কত্ব হবে রাষ্ট্রের চরিত্র।

সমাজতন্ত্র থেকে কমিউনিজমে উত্তরণ পর্যন্ত এ একনায়কত্ব ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা থাকবে।

সমগ্র বিশ্বে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা উৎখাতের পর রাষ্ট্রের বিলোপ সাধন সম্ভব।

কাজেই কেবলমাত্র কমিউনিস্ট সমাজই হচ্ছে শ্রেণীহীন–শোষণহীন।

মুজিববাদীরা বলছে বর্তমানেই পূর্ববাংলা শ্রেণীহীন হয়েছে যেহেতু পাক সামরিক ফ্যাসিস্টরা সবাইকে সর্বহারা করেছে।

শ্রেণীহীন হলে পুলিশ, সামরিক বাহিনী, জেল ও রাষ্ট্র রয়েছে কেন?

এগুলো রয়েছে ধনীদের সম্পত্তি রক্ষার জন্য, বিদেশী শোষকদের রক্ষার জন্য। ইহা প্রমাণ করে পূর্ব বাংলায় শ্রেণী রয়েছে।

এই শ্রেণীকে বিলোপের করার জন্য, বিপ্লবী সর্বহারার একনায়কত্ব প্রয়োজন। এ কথা না বলে রবগ্রুপ, আওয়ামী লীগ জনগণকে ভাওতা দিচ্ছে মাত্র।

শ্রেণীহীন সমাজে পৌছার জন্য অবশ্যই জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে। সর্বহারা একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সম্পন্ন করতে হবে। এর পরেই শ্রেণীহীন সমাজ অর্থাৎ কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

১২। জনগণের বিজয় অবশ্যম্ভাবী

প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রীরা সমাজতন্ত্রের বুলি দ্বারা জনগণকে প্রতারিত এবং চিরস্থায়ীভাবে তাদেরকে শোষণ ও লুন্ঠন করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

কিন্তু জনগণ তাদের প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা আজ হোক কাল হোক বুঝতে সক্ষম হবে এবং তাদেরকে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে।

পাক-ভারতের জনসাধারণ বৃটিশ উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর নির্মম শোষণ ও লুন্ঠনকে মেনে নেয়নি, তারা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়েছে।

শেষ পর্যন্ত বৃটিশ দস্যুরা উৎখাত হয়।

পূর্ববাংলার জনগণ বৃটিশ উপনিবেশিক দস্যুদের উপর নির্ভরশীল হিন্দু ধর্মাবলম্বী জমিদার-জোতদাদের মধ্যকার প্রতিক্রিয়াশীল অংশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিশেষ করে ধর্মীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, শেষ পর্যন্ত এরা উৎখাত হয়। এ সকল নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তির জন্য পূর্ববাংলার জনগণ পাকিস্তানে যোগদান করে।

কিন্তু পাকিস্তানের অবাঙ্গালী শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অবাধ বিকাশ ঘটতে দেওয়ার পরিবর্তে জাতিগত নিপীড়ন চালায় এবং পূর্ববাংলাকে উপনিবেশে পরিণত করে।

পূর্ববাংলার জনগণ এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।

পাকিস্তানের স্বাধীনতা আনয়নকারী রাজনৈতিক পার্টি মুসলীমলীগ এবং এর নেতা জিন্নাহ এককালে জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ শিখরে ছিল, তারা ক্রমে জনসমর্থন হারিয়ে ফেলে।

১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে জনসমর্থন পাকিস্তানের পক্ষে থাকায় ভারত পূর্ববাংলা বা পাকিস্তান দখল করতে ব্যর্থ হয়।

পূর্ববাংলার এই জনগণই জাতীয় অধিকার লাভের জন্য পাকিস্তানকে সমর্থন করার পরিবর্তে একে বিরোধিতা করে। তারা জাতীয় মুক্তির জন্য সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে।

‘পৃথিবীর কোন শক্তিই পূর্ববাংলাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না’— পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের এই দম্ভোক্তি মিথ্যা প্রমানিত হয়।

পূর্ববাংলা বিচ্ছিন্ন হয়।

পূর্ববাংলার জনগণ আওয়ামীলীগ ফ্যাসিস্টদের মিষ্টি কথায় বিশ্বাস করে, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের প্রতারণায় ভূলে তাকে মিত্র বলে অভ্যর্থনা করে।

পূর্ববাংলার জনগণ আওয়ামীলীগ ফ্যাসিস্টদের বিশ্বাসঘাতকতা ও ভারতীয় সম্প্রসারনবাদীদের প্রতারনা বুঝতে পেরেছে, জনগণ এদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে।

কাজেই এদের উৎখাত অনিবার্য।

বিপ্লব-পূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়নে বারোটিরও অধিক পার্টি ছিল যারা নিজেদেরকে সমাজতন্ত্রী বলে দাবি করতো। কিন্তু জনগণ এ সকল সমাজতন্ত্রীদের কথা-বার্তা ও কার্যকলাপ বিচার বিশ্লেষণ করে, জনগণের মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম কিনা তা বিবেচনা করে, শেষ পর্যন্ত তাদেরকে বর্জন করে।

মহান নেতা লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টিকে তারা মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম হিসেবে নির্ণয় করে এবং তার নেতৃত্ব গ্রহণ করে।

পূর্ববাংলার জনগণও আজ বিভিন্ন আকৃতির প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রী ও সংশোধনবাদীদের কথা ও কার্যকলাপকে পর্যালোচনা করছে, মুক্তি সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় উত্থাপিত সমস্যাবলীর সঠিক সমাধান দিতে সক্ষম কিনা তা তারা যাচাই করে দেখছে।

এভাবে তারা আজ হোক কাল হোক মেকী ও প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রীদের ও বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীদের বর্জন করবে এবং সত্যিকার সমাজতন্ত্রী ও বিপ্লবীদের গ্রহণ করবে।

পূর্ববাংলার জনগণ মনিসিং–মোজাফফর সংশোধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্রের ‘বি’টিমের চরিত্র অর্থাৎ আওয়ামীলীগ ফাসিস্টদের দালালীর চরিত্র বুঝতে পেরেছে। তাদের পতনও নির্ধারিত হয়ে গেছে।

রব গ্রুপের বক্তব্য তারা বুঝে উঠতে শুরু করেছে এবং সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় তাদের প্রকৃত মার্কিনের দালালীর চরিত্র এবং আওয়ামীলীগের অনুরূপ চরিত্র জনগণ বুঝতে সক্ষম হবে।

এদেরও পতন অনিবার্য।

কাজী-রনো-অমলসেন, দেবেন-বাসারদের……চরিত্রও জনগণ বুঝে ফেলেছে। তাদের পতনও অনিবার্য। হক-তোয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন নিজেদেরকে বিপ্লবী হিসেবে চিত্রিত করার এক হাজার একটা প্রচেষ্টা চালচ্ছে কিন্তু সমাজের গতিধারার প্রক্রিয়ায় উত্থাপিত ঝড়-তরঙ্গে তাদের মুখোশ উন্মোচিত হচ্ছে, তাদের দেঊলিয়াত্ব প্রমানিত হচ্ছে। জনগণ ও তাদের কেডাররা তাদেরকে পরিত্যাগ করছে। নিজেদেরকে বিপ্লবী হিসেবে চিত্রিত করার শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে তারা বারংবার বিভক্ত হয়ে একে অপরকে আক্রমণ করে নিজে খাটি বিপ্লবী সাজার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে।

তাদের পতন অনিবার্য।

কাজেই জনগণ, কেবলমাত্র জনগণই হচ্ছে বিশ্ব ইতিহাসের পরিচালক শক্তি। জনগণ বুদ্ধু বা বোকা নয়। অনেক সময় তারাই আমাদের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান, আমরাই তাদের তুলনায় অনেক সময় ছেলে মানুষ ও হাস্যস্পদ।

বর্তমান যুগে জনগণ চায় বিপ্লব, দেশ চায় স্বাধীনতা, জাতি চায় মুক্তি।

কাজেই জনগণকে বোকা ভেবে নিজেদেরকে অতিশয় চালাক মনে করে যারা গালভরা বুলি ঝেড়ে বিপ্লবীর মূখোশ পরে জনগণকে প্রতারণা করছে, জনগণের সাথে বিশাসঘাতকতা করছে তাদের পতন অতীতের প্রতিক্রিয়াশীলদের তুলনায় অতি দ্রুত হবে।

কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলরা স্বেচ্ছায় আত্নসমর্পন করবে না। গোলোযোগ সৃষ্টি করা, ব্যর্থ হওয়া, আবার গোলোযোগ সৃষ্টি করা, ব্যর্থ হওয়া, ধ্বংসের আগ পর্যন্ত এ নিয়ম অনুযায়ী তারা মৃত্যু পর্যন্ত প্রতারণা, বিশ্বাসঘতকতা, ও গোলোযোগ করে যাবে। এ কারণে জনগণের মুক্তির সংগ্রামে আসবে বিপর্যয়, পরাজয়, এ কারনে জনগণের মুক্তির পথ হচ্ছে আঁকাবাঁকা কষ্টকর।

“কিন্তু হতিহাসের নিয়ম অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা অবশেষে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে বদলাবেই, এটা মানুষের ইচছামুক্ত বাস্তব নিয়ম। প্রতিক্রিয়াশীলরা ইতিহাসের রথচক্রের গতি রোধ করার জন্য যত অপচেষ্টাই করুক না কেন, আগে বা পরে বিপ্লব অবশ্যই ঘটবে এবং তা অনিবার্য ভাবেই বিজয় লাভ করবে।”

প্রতিক্রিয়াশীল সমাজন্ত্রীরা সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়ে কিছু সংখ্যক লোককে কিছু দিনের জন্যে প্রতারিত করতে পারবে, কিন্তু সমগ্র জনগণকে চির দিনের জন্য ধোকা দিতে পারবে না।

সভাপতি মাও বলেছেন, “আজ থেকে শুরু করে পরবর্তী ৫০ থেকে ১০০ বছর, অথবা তার কম বা বেশী সময়টা হচ্ছে বিশ্বের সমাজ ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তনের মহান যুগ ও একটি বিশ্ব কাঁপানো যুগ। যার সঙ্গে পূর্ববর্তী কোন ঐতিহাসিক যুগের তুলনা হতে পারে না, এমন একটি যুগে বাস করে আমাদেরকে পূর্ববর্তী যুগগুলোর সংগ্রামের রূপ থেকে অনেক পৃথক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মহান সংগ্রাম চালানোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’’

সভাপতি আরো বলেছেন, “বর্তমান যুগের প্রধান প্রবণতা হচ্ছে বিপ্লব।”

পূর্ব বাংলা ও বিশ্বের ঘটনাবলী সভাপতি মাওয়ের এই উপসংহারের সঠিকতাই প্রমাণ করছে।

পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীদের বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করতে হবে, তাদের মূখোশ উন্মোচিত করতে হবে এবং তাদেরকে চূড়ান্তভাবে কবরস্ত করতে হবে।

জনগণকে তাদের মুক্তির পথে পরিচালিত করতে হবে, অব্যাহতভাবে বিপ্লব পরিচালনা করে পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সূচনা ও পরিচালনা  করতে হবে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে কমিউনিজম বাস্তবায়িত করতে হবে।

নোট

১। Karl Marx, Selected Works, Vol-I, p-155, Second English Edition, Foreign Language Publishing House, Moscow, 1946.

২। Mao Tse-Tung, Four Essays on Philosophy. P-9.

৩। সমাজতন্ত্রিক দেশসমুহে বুর্জোয়া শ্রেণী রয়েছে। বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী দেশসমুহও বর্তমান। সমাজতান্ত্রিক দেশের আভ্যন্তরীণ বুর্জোয়া এবং বাইরের সাম্রাজ্যবাদ প্রতিনিয়ত কমিউনিস্টদের বুর্জোয়ায় রূপান্তরিত করা এবং বুর্জোয়া সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধিদের পার্টিতে অনুপ্রবেশ করানোর প্রচেষ্টা চালায়। এর ফলে কমিউনিস্টদের কেউ কেউ বুর্জোয়ায় রূপান্তরিত হয়। এবং বুর্জোয়া সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধিরা পার্টিতে অনুপ্রবেশ করে। এরা মার্কসবাদের মূখোস পরে পার্টির মাঝে টাইম বোমা হিসাবে বিরাজ করে এবং পরে ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, কূ-দেতা প্রভৃতির মাধ্যমে পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা চালায়। এরাই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে আধুনিক সংশোধনবাদী বলে পরিচিত। এদের পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করার উদ্দেশ্য হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টিকে বুর্জোয়া ফ্যাসিস্ট পার্টিতে পরিণত করা, সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যব্যস্থাকে উৎখাত করে পুঁজিবাদ পুনপ্রতিষ্ঠা করা, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে বুর্জোয়া ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা।

৪। পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানী, মঙ্গোলিয়া ইত্যাদি।

৫। মাওসেতুঙ, উদ্ধৃতি, পৃষ্ঠা-২৭।

৬। Mao Tse-Tung, Four Essays on Philosophy, p-69.

৭। ইতালীর সংশোধনবাদী নেতা তোগলিয়াত্তির তত্ত্ব।

৮। Lenin, State and Revolution. P-40.

৯। ঐ পৃ-৪০।

১০। মাও, ছয়টি সামরিক প্রবন্ধ, পৃ-২৫।

১১। মাও, উদ্ধৃতি পৃ-৪৪।

১২। মাও, ছয়টি সামরিক প্রবন্ধ, পৃ-২৫।

১৩। মাও, উদ্ধৃতি, পৃ-৪৪।

১৪। মাও, উদ্ধৃতি, পৃ-৪৪।

১৫। মাওসেতুঙ।

১৬। মাও, উদ্ধৃতি, পৃ-২৬।

১৭। চীনা কমিউনিষ্ট পার্টির নবম জাতীয় কংগ্রেসে প্রদত্ত রিপোর্ট, পৃ-১৪৪।

১৮। ঐ।