সিরাজ সিকদার রচনাঃ প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির পঞ্চম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহার

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার


পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭২

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ১৩ আগস্ট ২০১৪


পিডিএফ

কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন ১৫ সেপ্টেম্বর শুরু হয় এবং ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২ সালে সাফল্যজনকভাবে সমাপ্ত হয়।

সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সকল সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি।

সভায় নিম্নলিখিত আলোচ্যসূচি গৃহীত হয় এবং সে অনুযায়ী সভা পরিচালত হয়।

আলোচ্যসূচী

১। রাজনৈতিক ২। সাংগঠনিক ৩। মতাদর্শগত ৪। সামরিক ৫। অর্থনৈতিক ৬। বিবিধ।

সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির চতুর্থ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহার, কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত দলিলাদি এবং সভাপতির নির্দেশসমূহ অনুমোদিত হয়।

সভায় সংগঠনের সামরিক ও অর্থনৈতিক বিষয় পর্যালোচনা করা হয় এবং সিদ্বান্ত গৃহীত হয় যে, সামরিক

ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হচ্ছে কেন্দ্রীয় বা প্রধান কাজ।

সভায় আরো সিদ্বান্ত গৃহীত হয় যে, সম্ভাবনাময় অঞ্চলে জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তির গেরিলা যুদ্ধ সূচনা করতে হবে এবং যে সকল স্থানে গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়েছে সেখানে তা জোরদার করতে হবে।

এ উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি নেতৃস্থানীয় কমরেডদের দায়িত্ব পুনর্বন্টন করে এবং গেরিলা যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরা ও তা জনপ্রিয় করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

সংগঠনের মতাদর্শগত ও সাংগঠনিক অবস্থা পর্যালোচনা করা হয় এবং নিম্নলিখিত সিদ্বান্ত গৃহীত হয়।

শুদ্ধি অভিযান ও চক্রবিরোধী সংগ্রাম হচ্ছে এ সকল ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কাজ।

গোড়ামীবাদ বিরোধী সংগ্রামকে এর সাথে যুক্ত করতে হবে।

প্রকাশ্য ও গণসংগঠনে কাজ

পার্টি পরিচিতি গোপন রেখে প্রকাশ্য, আধা প্রকাশ্য কাজ করা যায়। এর উদ্দেশ্য হবে কর্মী সংগ্রহ করা, সশস্ত্র সংগ্রামকে সহায়তা করা, শত্রুর সাথে জনগনের দ্বন্দ্ব তীব্রতর করা, শত্রুদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করা।

গণসংগঠন

প্রধান ধরনের গণসংগঠন হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী।

প্রকাশ্য, আধাপ্রকাশ্য এবং গণসংগঠনের কাজের উদ্দেশ্য হবে সশস্ত্র সংগ্রামকে সহায়তা করা, কর্মী সংগ্রহ করা ইত্যাদি।

শত্রু এলাকায় ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত কাজ

প্রতিক্রিয়াশীলরা যে সকল ট্রেড ইউনিয়ন দখল করেছে সেখানে পাল্টা ট্রেড ইউনিয়ন বা কেন্দ্রীয় ভিত্তিতে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন না করা। এ সকল ক্ষেত্রে পার্টি পরিচিতি গোপন রেখে অনুপ্রবেশ করা এবং পূর্বে উল্লেখিত লক্ষ্য বাস্তবায়িত করা।

যেখানে প্রতিক্রিয়াশীলরা ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করেনি, সেখানে পার্টির কর্মীদের নেতৃত্বে (পার্টি পরিচিতি গোপন রেখে) ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা।

স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্ব বজায় রাখতে অসুবিধা হলে কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ত হওয়া।

প্রকাশ্য ও গণসংগঠনের কাজকে গোপন ও সশস্ত্র সংগ্রাম-এর সাথে যথাযথভাবে সমন্বিত করতে হবে, গোপন কাজ ও সশস্ত্র সংগ্রাম হবে প্রধান কাজের পদ্বতি।

মুক্ত অঞ্চলে প্রকাশ্য গণসংগঠন করতে হবে।

আধামুক্ত অঞ্চল বা অস্থায়ী মুক্তাঞ্চলে প্রকাশ্য, আধাপ্রকাশ্য ও গোপন সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।

● অধিবেশনে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত সিদ্বান্ত গৃহীত হয়

পূর্ববাংলার জনগণ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও ছয় পাহাড়ের দালালদের বিরুদ্ধে মারাত্মকভাবে বিক্ষুব্ধ।

তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছয় পাহাড়ের দালালদের খতম করছে।

জনগনের এ স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামকে নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে।

বিভিন্ন স্থানে পার্টির নামে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সর্বহারা বিপ্লবীরা কাজ করছে। তাদের সাথে যোগাযোগ করে তাদেরকে পার্টির নেতৃত্বে সংগঠিত করা উচিত। এ প্রসঙ্গে প্রকাশিত দলিল অনুযায়ী কাজ করতে হবে (পরিশিষ্ট-১ দ্রষ্টব্য)।

কাজী-অমল, দেবেন-বাসার এবং অন্যান্য নয়া সংশোধনবাদীরা ভাসানীর নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেছে এবং বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের পরিণতি ভারতের জ্যোতি বসুদের দ্বারা গঠিত বিভিন্ন ঐক্যফ্রন্টের চাইতেও খারাপ হবে। এদের পতন অনিবার্য।

ইহা জনগণকে বিভ্রান্ত করা ব্যতীত আর কিছুই নয়।

এদের দ্বারা পরিচালিত প্রকাশ্য গণসংগ্রামকে (উদাহারণ ভূখা মিছিল ইত্যাদি) এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও ছয় পাহাড়ের দালাল বিরোধী প্রচারণাকে আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য ব্যবহার করতে হবে।

বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীদের এবং তথাকথিত সমাজতন্ত্রীদের মুখোশ উন্মোচিত করতে হবে।

হক-তোয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন নয়া সংশোধনবাদীদের ভুল রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক ও অন্যান্য লাইন কর্মীদের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে।

এদের কর্মীরা শৃংখলা পালন করে না, ইচ্ছা-খুশীমত ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করে।

এরা পার্টির চাইতে কর্মীদেরকে ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল করে তোলে, ব্যক্তিগত এলাকা গড়ে তোলে।

এ কারণে এরা এক একজন এক একটি দূর্গ গঠন করে (পাবনা-মতিনের দূর্গ, নোয়াখালী-তোয়াহার দূর্গ, যশোর-হকের দূর্গ ইত্যাদি)।

▬ এদের কোন সাংগঠনিক স্তর নেই।

▬ কর্মীদের মাঝে ব্যক্তিতাবাদ রয়েছে।

▬ সংগঠন কেন্দ্রীয় ভিত্তিতে সংগঠিত নয়।

▬ এরা সমালোচনা-আত্মসমালোচনা করে না।

▬ এদের গোপন কার্য-পদ্ধতি নেই।

ইহা প্রমাণ করে ভুল রাজনৈতিক লাইন অবশ্যই ভুল সাংগঠনিক লাইনে প্রকাশ পায়। এদের পতন অনিবার্য।

মনিসিং-মোজাফফর সংশোধনবাদী ও তাদের সংগঠনসমূহ ইতিমধ্যেই ছয় পাহাড়ের দালালদের ‘বি’ টিম হিসেবে জনগণের সামনে পরিচিত হয়েছে। জনগণ থেকে এরা দ্রুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এদের পতন অনিবার্য।

পূর্ববাংলার জনগণের ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও ছয় পাহাড়ের দালাল বিরোধী প্রচণ্ড গণ অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীরা পূর্ববাংলায় তাদের দালালদের সহযোগিতায় প্রতিবিপ্লবী ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র করছে। এ উদ্দেশ্যে তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-রায়ট বাধানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

এ সকলের উদ্দেশ্য হলো পূর্ববাংলায় মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের উপনিবেশ স্থাপন করা। আমাদের সতর্কতা জোরদার করতে হবে, এ ষড়যন্ত্রকে উদ্ঘাটিত করতে হবে (পরিশিষ্ট-২ দ্রষ্টব্য), শত্রুদের মধ্যকার (মার্কিনের নেতৃত্বের সাম্রাজ্যবাদী ও তার দালালদের সাথে সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার দালালদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব) দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করতে হবে, এ দ্বন্দ্বের ফলে সৃষ্ট সংকটের সুযোগ গ্রহণ করতে হবে।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সুবিধাজনক বিপ্লবী পরিস্থিতিতে আমদের বিপ্লবী তৎপরতা জোরদার করতে হবে।

‘বাংলাদেশ’কে জাতিসংঘে প্রবেশের বিরুদ্ধে ভেটো প্রদান করে চীন সঠিক ভুমিকা গ্রহণ করেছে।

চীনের এ ভেটো প্রদানকে ছয় পাহাড়ের দালাল ও তার প্রভুরা চীন বিরোধী এবং কমিউনিস্ট বিরোধী জনমত সৃষ্টির জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এর অপর উদ্দেশ্য হলো জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরানো এবং বামপন্থী খতম করা।

বিবিধ আলোচনাসূচিতে নিম্নলিখিত সিদ্ধ্বান্তসমূহ গৃহীত হয়ঃ

সংগঠনের অর্থনৈতিক হিসাব (জুলাই-আগস্ট, ১৯৭২) মোটামুটি পর্যালোচনা করা হয় এবং গৃহীত হয়।

কোন লিফলেট বা দলিল বিতরণের পূর্বে ছাপানো কপি যথাযথ স্তর কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে। কেডার ইতিহাসের অতিরিক্ত পয়েন্টসমূহে “দীর্ঘস্থায়ী ও দুরারোগ্য এবং মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি রয়েছে কিনা” এ পয়েন্ট যুক্ত হবে।

দাম্পত্য জীবন সংক্রান্ত পার্টির অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া যায় – বিবাহ ইচ্ছুক নর ও নারী কমরেডগণ মোটামুটি সুদীর্ঘ দিন সঠিকভাবে পরস্পরকে বুঝা ও যাচাই করার জন্য ঘনিষ্টভাবে জীবন করা উচিত।

ইহা যথাযথ স্তর কর্তৃক অনুমোদিত হবে।

এ ব্যবস্থা পূর্ব থেকেই বহাল থাকলে দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক ভুল ও বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হতো।

সভায় সকল সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। পরবর্তী সভার তারিখ নির্ধারণ করে সভার কাজ সাফল্যজনকভাবে সমাপ্ত হয়।

পরিশিষ্ট-১

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির সাথে যোগাযোগ হয়নি কিন্তু নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে পার্টির লাইনে কাজ করছেন এরূপ বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যে সর্বহারা পার্টির আহবান

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির সাথে যোগাযোগ হয়নি এরূপ বহু বিপ্লবী পূর্ববাংলার বিভিন্ন স্থানে সর্বহারা পার্টির লাইনে ও পার্টির নামে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করছেন।

আপনাদের কারো কারো সাথে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির সাথে যোগাযোগ হয়েছে, কারো কারো সাথে যোগাযোগ হচ্ছে। আবার আপনাদের কেউ কেউ পোস্টার, লিফলেটের মাধ্যমে পার্টির সাথে যোগাযোগের আবেদন জানাচ্ছেন। পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি আপনাদেরকে নিম্নলিখিত বিপ্লবী দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানাচ্ছে।

১) আপনারা পার্টির লাইনে গোপনভাবে (underground) নিরাপত্তা বজায় রেখে কাজ করে যান।

২) শত্রুর চর নয় এরূপ ব্যক্তিদেরকে পাঠচক্র, গেরিলা গ্রুপে সংগঠিত করুন। তাদেরকে পাঁচটি প্রবন্ধ, গণযুদ্ধ, উদ্ধৃতি, তিনটি বৃহৎ শৃংখলা, মনোযোগ দেবার আটটি ধারা পড়ান। তারা তিনটি বৃহৎ শৃংখলা ও মনোযোগ দেবার আটটি ধারা অবশ্যই পালন করবেন।

৩) পার্টির সাথে দ্রুত যোগাযোগের চেষ্টা করুন।

৪) পার্টির সাথে যোগাযোগের পূর্বে এবং পার্টির যথাযথ অনুমতি ব্যতীত খতম বা হামলা করবেন না। তবে আত্মরক্ষার্থে প্রমাণিত ও জনগণ কর্তৃক ঘৃণিত শত্রুদের খতম করা যায়।

ব্যক্তিগত শত্রুতা উদ্ধারের জন্য কোন রকম খতম বা হামলা চরম অপরাধ বলে পরিগণিত হবে।

৫) পার্টির অনুমতি ব্যতীত স্বতঃস্ফূর্তভাবে খতম বা হামলার কুফল নিম্নরূপঃ

এর সুযোগ গ্রহণ করে সরকার এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুর চরেরা সর্বহারা পার্টির নামে দেশপ্রেমিক নিরীহ লোকদের খতম ও হামলা করতে পারে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের মনে পার্টি সম্পর্কে ভীতি ও বিরূপ ধারণা জন্মানো এবং জনগণ থেকে পার্টিকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। ভারতের গোয়েন্দা বিভাগ ও সাম্রাজ্যবাদের চরেরা সর্বহারা বিপ্লবীদের নামে ব্যাপকভাবে এরূপ জঘন্য কাজ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের সর্বহারা বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা, তাদেরকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা। এর ফলে কোন কোন ক্ষেত্রে জনগণের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়।

কাজেই স্বতঃস্ফূর্ত হামলা, খতম সম্পূর্ণ অননুমোদনীয়। সর্বহারা বিপ্লবীরা এরূপ জঘন্য প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপকে বিরোধিতা করবেন। তাদের অপরাধ জনগণের সামনে তুলে ধরবেন, তাদের যথাযথ শাস্তি দিবেন।

৬) আপনাদের নিকটস্থ অস্ত্র ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি গোপনে রেখে দিন।

৭) পার্টির সাথে যোগাযোগ করে অস্ত্র ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি এবং আপনাদের কার্যাবলী, যোগাযোগ ও কর্মীদের পার্টির নিকট বুঝিয়ে দিন।

পার্টিতে সাংগঠনিকভাবে যোগদান করুন।

৮) পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মীরা খুবই সতর্কতা অবলম্বন করবেন, যথাযথ অনুসন্ধান করবেন, যাতে এ প্রক্রিয়ায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রু চরেরা পার্টিতে ঢুকে না পড়ে।

পরিশিষ্ট-২

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল

ছাত্রলীগের রব-গ্রুপের নিকট কয়েকটি প্রশ্ন

১) আপনার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলেন এবং মার্কসবাদ মানেন একথাও বলেন। মার্কসবাদ শিক্ষা দেয়, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মৌলিক বিষয় হলো সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা ও তা রক্ষা করা। কিন্তু আপনারা সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলেন না (মনি সিং-মোজাফফর চক্রও বলেনা)। সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা না করার অর্থ হল সামন্তবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের দালালদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা। যেহেতু আপনাদের সমাজতন্ত্র সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করবে না সেহেতু ইহা সামন্তবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের দালালদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করবে ও তাদের শোষণ ও লুন্ঠন কায়েম করবে।

এর অর্থ হচ্ছে ভারত ও সোভিয়েতের তাবেদাররা মুজিববাদের নামে যে শোষণ ও লুন্ঠন করছে এবং ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব কায়েম করেছে, এর পরিবর্তে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তাবেদারদের শোষণ ও লুন্ঠন এবং ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব কায়েম করা।

এ কারণেই সর্বহারার একনায়কত্ব ব্যতীত সমাজতন্ত্র হচ্ছে জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ও ফ্যাসিবাদ।

২) আপনারা মার্কসবাদ মানেন, মার্কসবাদ শিক্ষা দেয় যে, জাতীয় ও গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা করতে হয়। পূর্ববাংলায় কি জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে?

পূর্ববাংলায় জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি। অর্থাৎ পূর্ববাংলা পাকিস্তানের উপনিবেশ থেকে ভারতের উপনিবেশে পরিণত হয়েছে, এখানে সাম্রাজ্যবাদের দালালদের শোষণ এবং জমিদারদের শোষণ বিদ্যমান।

জনগণ চায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালালদের উৎখাত করে জাতীয় বিপ্লব সম্পন্ন করতে, স্বাধীন, সার্বভৌম পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠা করতে এবং জোতদার-জমিদারদের উৎখাত করে গণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠা করতে।

আপনারা গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার কথার পরিবর্তে সমাজতন্ত্রের কথা বলে জনগণকে তাদের বর্তমানের প্রকৃত শত্রু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালালদের আড়াল করছেন। ইহা প্রকৃতপক্ষে শত্রুর তাবেদারী ব্যতীত আর কিছুই নয়। এ কারণেই আপনারা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের প্রশ্নে নীরব।

৩। মার্কসবাদ শিক্ষা দেয় যে, জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন না করে সমাজতন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে ট্রটস্কীবাদ। বর্তমান বিশ্বে ট্রটস্কীবাদীরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা পরিচালিত। আপনাদের সমাজতন্ত্রের কথা কি প্রমাণ করে না যে, আপনারা ট্রটস্কীবাদী এবং এ কারণে আপনারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা পরিচালিত?

৪। আপনারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লবের কথা বলেন। কিন্তু মার্কসবাদ শিক্ষা দেয় যে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারায় সুসজ্জিত সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব ব্যতীত এর কোনটাই সম্ভব নয়। তার প্রমাণ হলো পূর্ববাংলার বুর্জোয়ারা তথাকথিত সামাজিক বিপ্লবের কথা, শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলে পূর্ববাংলাকে ভারতের উপনিবেশে পরিণত করেছে। এভাবে তারা সামাজিক বিপ্লবের নামে সামাজিক প্রতিবিপ্লব ঘটায়, শ্রেণী সংগ্রামের নামে শ্রেণী ও জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা করে। একইভাবে আপনারাও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, সামাজিক বিপ্লব, শ্রেণী সংগ্রামের নামে প্রকৃত পক্ষে পূর্ববাংলাকে মার্কিনের উপনিবেশে পরিণত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এভাবে সামাজিক প্রতিবিপ্লব, শ্রেণী ও জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা করছেন।

৫) আপনারা শ্রেণী সংগ্রাম ও শ্রেণী শত্রু খতমের কথা বলেন।

বর্তমানে পূর্ববাংলার জনগণের দাবী হচ্ছে জাতীয় সংগ্রাম করা (পূর্ববাংলাকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে স্বাধীন করা), জাতীয় শত্রু খতম করা (ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালালদের জাতীয় শত্রু হিসেবে খতম করা)।

শ্রেণী সংগ্রাম ও শ্রেণী শত্রু খতমের নামে আপনারা প্রকৃতপক্ষে জাতীয় শত্রুদের বাঁচিয়ে দিচ্ছেন। ইহা কি জাতীয় শত্রুদের তাবেদারী নয়?

আপনারা কেউ কেউ শ্রেণী শত্রু হিসেবে পূর্ববাংলার প্রকৃত বামপন্থীদের (যাদেরকে চীনের দালাল বলা হয়) চিহ্নিত করেন। বর্তমানে আপনারা প্রকৃত বামপন্থী দেশপ্রেমিক কর্মীদের (আমাদের সহ অন্যান্যদের) তালিকা প্রণয়ন করছেন এবং নিজেরা বা মুজিববাদীদের সহায়তায় ধরিয়ে দিচ্ছেন বা খতম করছেন।

৬) শ্রেণী সংগ্রাম, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, সামাজিক বিপ্লবের কথা বললেও আপনারা মার্কসবাদী বা বিপ্লবী নন, ইহা লেনিনের নিম্নলিখিত উদ্ধৃতিটিই প্রমাণ করছে—

“এটা প্রায়ই বলা এবং লেখা হয় যে মার্কসের তত্ত্বের সারবস্তু হলো শ্রেণীসংগ্রাম, এটা সত্য নয়। এ মিথ্যা থেকে প্রায়ই বেরিয়ে আসে মার্কসবাদের সুবিধাবাদী বিকৃতি, একে মিথ্যা করে বুর্জোয়াদের নিকট গ্রহণীয় করে তোলা। কারণ শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্ব মার্কস কর্তৃক সৃষ্ট নয়। মার্কসের পূর্বে বুর্জোয়ারাই ইহা সৃষ্টি করেছে। সাধারণভাবে ইহা বুর্জোয়াদের নিকট গ্রহণীয়। যারা শুধু শ্রেণীসংগ্রামকে স্বীকার করে তারা এখনও মার্কসবাদী হয়নি, তারা এখনো বুর্জোয়া চিন্তা এবং বুর্জোয়া রাজনীতির আওতায় রয়ে গেছে। মার্কসবাদকে শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বে সীমাবদ্ধ রাখার অর্থ হলো মার্কসবাদকে খর্ব করা, বিকৃত করা, বুর্জোয়াদের নিকট গ্রহণীয় এরূপ বিষয়ে রূপান্তরিত করা। কেবলমাত্র সে-ই একজন মার্কসবাদী যে শ্রেণী সংগ্রামের স্বীকৃতিকে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের স্বীকৃতিতে প্রসারিত করে। এটাই হচ্ছে মার্কসবাদী এবং সাধারণ ক্ষুদে বুর্জোয়া (বড় বুর্জোয়াদেরও) মধ্যকার পার্থক্য।” [Lenin on Proletarian Revolution and Proletarian Dictatorship. Foreign Language Press, Peking, 1960, Page-9]

এ থেকে পাওয়া যায় শ্রেণী সংগ্রামের কথা বললেই মার্কসবাদী বা বিপ্লবী হওয়া যায় না। ইহা বড় বুর্জোয়া এমন কি সাম্রাজ্যবাদের দালালরাও বলতে পারে।

৭) আপনারা তথাকথিত সরকারবিরোধিতা এবং প্রগতি মার্কা বক্তব্য ও শ্লোগানের পিছনে আন্তরিক কর্মীদের আকৃষ্ট করে ভুল পথে পরিচালনা করছেন। এভাবে তাদেরকে মুজিববাদের শিকারে পরিণত করেছেন। ইতিমধ্যে জাসদ ও তার সাথে যুক্ত সংগঠনসমূহের বহু কর্মী মুজিববাদীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন বা জেল জুলুম নির্যাতন ভোগ করছেন।

ইহা কি আন্তরিক দেশপ্রেমিক কর্মীদের জন্য ফাঁদ তৈরী করা নয়?

৮) আপনারা প্রকাশ্যে মুসলিম বাংলার বিরোধিতা করেন কিন্তু গোপনে কর্মীদের মাধ্যমে মুসলিম বাংলার প্রচার করে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করছেন, এভাবে মার্কিনের ষড়যন্ত্র মত কাজ করছেন।

প্রকৃতপক্ষেই আপনারা যদি মার্কসবাদ মানেন, সাম্রাজ্যবাদের সাথে যুক্ত না হন, জনগণের সেবক হন তাহলে উপোরক্ত ভুল বক্তব্য ও কর্মপদ্ধতিসমূহ সংশোধন করে সত্যিকার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টিতে ঐক্যবদ্ধ হোন এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে স্বাধীন, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ববাংলার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন। ইহা কায়েম সম্ভব জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তির গণযুদ্ধ সূচনা ও পরিচালনা করে। এই জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা করতে হবে।

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা—জিন্দাবাদ!

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি—জিন্দাবাদ!

কমরেড সিরাজ সিকদার—জিন্দাবাদ!