পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ ১৯৭২
কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ৭ মার্চ ২০১৪
পিডিএফ
ফজলু-সুলতান চক্রের পার্টি, জনগণ ও বিপ্লব বিরোধী কার্যকলাপের ভিত্তি হিসাবে যে সকল প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব কাজ করছে তা হলোঃ ‘কমিউনিষ্টদের কিছুটা ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে’, ‘যৌনতাকে কি অস্বীকার করা যায়?’ ‘আমি খুব জনপ্রিয়’, ‘সমালোচনা সামনে করতে ভয় পাই’ ইত্যাদি। এগুলো হলো পুরোপুরি বুর্জোয়া তত্ত্ব যার সারবস্ত হল ব্যক্তিস্বার্থ।
আমাদের অবশ্যই এ সকল প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্বসমূহের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে।
কমিউনিষ্ট মতাদর্শ জনগণের স্বার্থকে কেন্দ্র করে আবতির্ত। পক্ষান্তরে সকল শোষক শ্রেণীর মতাদর্শ হল ব্যক্তিস্বার্থ কেন্দ্র করে আবর্তিত। কমিউনিষ্টদের কোন প্রকার ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে না। তারা সম্পূর্ণরূপে জনগণের মুক্তির জন্য এবং পুরোপুরিই জনগণের স্বার্থের জন্য কাজ করে। জনগণের সেবাই ও জনগণের স্বার্থই তাদের সকল কাজের যাত্রাবিন্দু।
আমরা ক্ষুদে বুর্জোয়া, সামন্তবাদী ও বুর্জোয়া সমাজ থেকে আগত এবং এর দ্বারা ঘিরে আছি। স্বাভাবিকভাবেই আমরা বিভিন্ন আকৃতির ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে আসি ও প্রতিনিয়ত অর্জন করি।
কাজেই কমিউনিষ্ট হওয়ার জন্য এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে, একে প্রতিনিয়ত দূর করতে হবে, নিজেকে যাচাই করতে হবে। সভাপ্রতি মাও বলেছেন, “ব্যক্তিস্বার্থের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো, সংশোধনবাদকে বিরোধিতা করো।”
কোন প্রকার ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে না—এরূপ হল আদর্শ কমিউনিস্ট। কমিউনিস্টদের জন্য সর্বনিম্ন গুণ ব্যক্তিস্বার্থকে বিপ্লব ও জনগণের, পার্টির স্বার্থের অধীন করা।
কমিউনিস্টদের কিছুটা ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে এ কথার অর্থ হল একে বজায় রাখা, একে পোষণ করা, এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা না করা।
এর পরিণতি কি? এর পরিণতি হল পার্টি পদের জন্য লড়াই করা, কর্তা ব্যক্তি হওয়ার জন্য চক্রান্ত করা, উপদলীয় ষড়যন্ত্র করা, গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা করা, শেষ পর্যন্ত পার্টির অর্থ চুরি করা, পার্টি, জনগণ ও বিপ্লব বিরোধী কাজ করা।
কিছুটা ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে এ ছিদ্র দিয়ে ফজলু-সুলতান চক্রের সকল ব্যক্তিস্বার্থ ঢুকে পড়েছে, ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে, তারা প্রতিক্রিয়াশীলে রূপান্তরিত হয়েছে।
কাজেই কমিউনিষ্টদের কোন ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে না—এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সকল ব্যক্তিস্বার্থের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করলে আমাদেরও পরিণতি হবে ফজলু-সুলতান চক্রের অনুরূপ।
ফজলু-সুলতান চক্র বলতো যৌনতাকে কি অস্বীকার করা যায়? অর্থাৎ অপরিবর্তিত ক্ষুদে বুর্জোয়া মেয়ের সাথে প্রেমকে যৌন কারণে বাদ দেওয়া যায় না। যৌন কারণে তাকে বিয়ে করতে হবে। অর্থাৎ বিপ্লব, পার্টি ও জনগণের ক্ষতি হবে জেনেও শুধু যৌন কারণে অপরিবর্তিত বুদ্ধিজীবী মেয়েদের বিয়ে করা, যৌনতার কাছে আত্নসমর্পণ করা।
এটা হল যৌন স্বার্থের নিকট বিপ্লব, জনগণ ও পার্টি স্বার্থকে অধীন করা।
ফজলু পূর্ববাংলার শ্রমিক আন্দোলনে যোগদানের কিছুদিন পরে পাশ করলেই বিয়ে করা যাবে, এ কারণে সুবিধাবাদী হয়ে পরীক্ষা দেয়, ক্ষুদে বুর্জোয়া সূলভ পত্র লেখে, জেলে প্রেমিকার চিন্তায় বিভোর থাকে, জেল থেকে বেরিয়ে পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের চরম নির্যাতনের সময় বিয়ের কাজ প্রাধান্য দেয়; ব্যক্তিস্বার্থে প্রেমিকাকে নিয়ে আসে, ফ্রন্টের দ্বায়িত্ব ভুলে যেয়ে প্রেমিকার নিরাপত্তার জন্য নিজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে বাড়ীতে যায়, সেখানে প্রেমিকার জন্য ফ্রন্টের দায়িত্ব ভুলে থেকে যায়, অর্থ-অস্ত্র হারায়, পরে পার্টি তাকে কাজ দিলে সেখানে প্রেমিকার চিন্তায় কাজে অমনোযোগ প্রদর্শন করে, শেষ পর্যন্ত উক্ত দায়িত্ব থেকে অপসারণ চায়, প্রেমিকাকে আকাশ-কুসুম কল্পনা করে, শেষ পর্যন্ত প্রেমিকার চিন্তায় আত্নহত্যা করতে পদক্ষেপ নেয়, মানসিক বিকার জন্মায়, প্রেমিকার অভিযোগে পার্টির প্রতি অসন্তুষ্ট হয়।
সুলতানচক্র পার্টিতে যোগদানের পূর্বেকার ভ্রষ্ট জীবনের নারী সংক্রান্ত চরম স্বেচ্ছাচার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সতর্ক হওয়া, তা সংশোধন করা, অনুতপ্ত হওয়ার পরিবর্তে পার্টিতে এসেও নারীঘটিত দুর্ঘটনা ঘটায়, পার্টি তার বিষয়ে অনুসন্ধ্যান চালিয়ে তাকে সতর্ক করে, এতে অনুতপ্ত না হয়ে একই ধরণের ঘটনা সে পুনরায় ঘটায়, ষড়যন্ত্র করে, মিথ্যা বলে, সুবিধাবাদীতে পরিণত হয়।
এভাবে ফজলু-সুলতান চক্র যৌন স্বার্থের নিকট বিপ্লব ও জনগণের স্বার্থকে অধীন করে।
এর পরিণতি কি?
এর পরিণতি হল সুলতান-ফজলু চক্র গঠন, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চালানো পার্টির অর্থ চুরি, শেষ পর্যন্ত পার্টি, বিপ্লব, জনগণের স্বার্থের ক্ষতি করা।
প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের সারসংকলন ও সাধারণীকরণই হচ্ছে দর্শন। কাজেই সামাজিক ক্ষেত্রের প্রতিটি সংগ্রাম অনিবার্যভাবেই প্রতিফলিত হবে দর্শনের ক্ষেত্রে। কাজেই ফজলু-সুলতান চক্র সম্পর্কিত সংগ্রাম দর্শনের ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হবে।
যৌনতাকে মার্কসবাদীরা অস্বীকার করে না, যেহেতু এটা বস্তুগত বাস্তবতা, অর্থাৎ বস্তু নিজে নিজেই বিরাজ করছে।
কিন্তু বস্তুবাদী ও ভাববাদীদের পার্থক্য হল, বস্তুবাদীরা বস্তুকে স্বীকার করে, তার নিয়মবিধিকে আবিস্কার করে তাকে রূপান্তরিত করে আমাদের অধীনে নিয়ে আসে।
পক্ষান্তরে বস্তুকে ভাববাদীরা পুরোপুরি জানা ও তাকে আমাদের অধীনে আনা, তাকে বশে আনাকে অস্বীকার করে। তারা বলে বস্তু প্রকৃতির খেয়ালমত চলবে।
যৌন ক্ষেত্রে এটা প্রয়োগ করলে দাঁড়ায়, ভাববাদীরা বলে যৌনতাকে অস্বীকার করা যায় না। আর বস্তুবাদীরা বলে যৌনতাকে অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু তার নিয়মবিধি জেনে তাকে আমাদের বশে, অধীনে আনা যায়।
অর্থাৎ বস্তু নিজে নিজেই বিরাজ করে, তাকে আমাদের জন্য বস্তুতে রূপান্তরিত করা যায়।
কাজেই যৌনতাকে অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু অবশ্যই তার নিয়মবিধি জেনে তাকে বিপ্লব, জনগণ ও পার্টির স্বার্থের অধীনে আনা উচিৎ।
কাজেই ফজলু-সুলতান চক্র ভাববাদী।
ফজলু বলতো, আমি খুব জনপ্রিয়।
ফজলুর জনপ্রিয়তা হয়েছে পার্টির সঠিক রাজনীতি ও কর্মপদ্ধতি এবং তা প্রয়োগের দ্বারা ও কমরেডদের আত্মত্যাগের ফলে।
এ জনপ্রিয়তা তার পরিবার-পরিজন, বা অন্য কোন কারণেই হয়নি। তার এ কথা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ পরিপন্থী।
ইতিহাসের গতিধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কার্যকলাপই ‘বীর’ তৈরী করবে।
অর্থাৎ জনগণই হচ্ছে ইতিহাসের পরিচালক শক্তি। এ জনগণকে ইতিহাস পরিবর্তনে যারা নেতৃত্ব দেয় তারাই জনপ্রিয় হয়। পূর্ববাংলার জনগণের ইতিহাস পরিবর্তনে সংগ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব বর্তমানে সর্বহারা পার্টির ওপর ন্যস্ত। এই সর্বহারা পার্টি তার সংগ্রাম প্রক্রিয়ায় সঠিক নেতা ও নেতৃত্ব গড়ে তুলবে যারা হবে জনপ্রিয়। কাজেই পার্টি এবং কমরেডদের থেকে বিচ্ছন্ন করে কোন ব্যক্তিবিশেষের জনপ্রিয়তার কোন অস্তিত্ব রয়েছে কি? এ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন ব্যক্তিবিশেষের প্রচেষ্টা কোন উপকারে আসবে কি?
মোটেই আসবে না। এ কারণেই সভাপতি মাও বলেছেন, “পার্টি ও জনগণের ওপর আস্থা রাখ, এ ছাড়া কিছুই করতে পারবে না।”
কাজেই পার্টি–জনগণের বাইরে জনপ্রিয়তা থাকতেই পারে না। কাজেই ফজলু যে জনপ্রিয়তার কথা বলে তা হচ্ছে পার্টি, কমরেড ও জনগণের সংগ্রামের ফলশ্রুতি।
পার্টি, কমরেড ও জনগণের বাইরে তার কোন জনপ্রিয়তাই থাকবে না, থাকতে পারে না।
কাজেই যে জনপ্রিয়তার বড়াই করে ফজলু চক্র গঠনের সাহস করছে, পার্টির থেকে, এর সঠিক নীতি ও কর্মপদ্ধতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে জনপ্রিয়তা অচিরেই রূপান্তরিত হবে জনগণের ঘৃণায়, তার কার্যকলাপ হবে ডাকাত, ভাওতাবাজ, প্রতারকদের অনুরূপ।
কারণ, পার্টির সঠিক নীতি ও কর্মপদ্ধতির বাইরে দেশপ্রেমিকদের কাজ ব্যতীত অন্য সকল কাজই ডাকাতি, ভাওতাবাজী, প্রতারণা।
ফজলু-সুলতান চক্র বলতো, ‘সমালোচনা করতে ভয় লাগে’। তার প্রকৃত অর্থ হল তারা মুক্ত মনে অকপটে সকল মনের কথা প্রকাশ করতে ভয় পেত।
কারণ তাদের মধ্যকার ভুল চিন্তাধারা প্রকাশ হয়ে পড়বে, তা সমালোচিত হবে।
তারা আরো মনে করতো ভুল বক্তব্যের সমালোচনা হলে তাদের মান ক্ষয়ে যাবে, তাদের সম্পর্কে ধারণা খারাপ হয়ে যাবে। তারা উচ্চপদে থাকতে পারবে না।
তারা পদকে আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিল। এ কারণেই অকপট, মুক্ত মনে সকল কথা বলতে পারেনি, সমালোচনার ভয়ে নয়।
তাদের এ সকল ভুল তত্ত্বের পরিণতি হল, কিছুটা ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে, এ কথা বলে তারা সকল ব্যক্তিস্বার্থকে বজায় রাখে। ‘যৌনতাকে কি অস্বীকার করা যায়?’—এ কথা বলে যৌনতার নিকট পার্টি, বিপ্লব ও জনগণের স্বার্থকে বিকিয়ে দেয়, ‘আমি খুব জনপ্রিয়’—এ কথা বলে নিজেকে তারা কেউকেটা মনে করে, জনগণ ও পার্টির ওপর আস্থা হারায়।
সমালোচনার ভয় করে বলে তারা কপট হয়, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে।
সকল বিষয়ের পরিণতি হিসাবে তারা চক্র গঠন করে, অর্থ চুরি করে, পার্টির কমরেডদেরকে গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা করে, বিপ্লব ও জনগণের স্বার্থকে বিভিন্ন ব্যক্তিস্বার্থের অধীন করে ফেলে এবং প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবীতে রূপান্তরিত হয়।■