মাও সেতুঙ। মানুষের সঠিক চিন্তা কোথা থেকে আসে?

পিডিএফ  মুদ্রনের জন্য পিডিএফ

এই প্রবন্ধটি “গ্রামের বর্তমান কাজের কতগুলি সমস্যা সম্পর্কে চীনা সাম্যবাদী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির (খসড়া) সিদ্ধান্ত”র একটি অনুচ্ছেদ। এই খসড়া সিদ্ধান্ত কমরেড মাও সেতুঙের পরিচালনায় ১৯৬৩ সালের মে মাসে রচিত হয়েছিল। এই অনুচ্ছেদটি কমরেড মাও সেতুঙ নিজেই লিখেছিলেন।

১৯৬৫ সালের এপ্রিল মাসে চীনের পিকিং গণ প্রকাশন কর্তৃক চীনা ভাষায় প্রকাশিত “মাও সেতুঙ রচনাবলীর নির্বাচিত পাঠ”-এর দ্বিতীয় সংস্করণে এই অনুচ্ছেদটি প্রকাশিত হয়। উক্ত সংস্করণ থেকে বিদেশী ভাষা প্রকাশনা পিকিং বাংলায় ভাষান্তর করে প্রকাশ করে।

মাও সেতুঙ

মাও সেতুঙ

উক্ত ভাষান্তরে সামান্য কিছু ভাষাগত সম্পাদনা করে বাংলাদেশের সাম্যবাদী পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদীর কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ ৮ই জুন, ২০২৩ প্রকাশ করে। সর্বহারা পথ ওয়েবসাইট থেকে এই সংস্করণটির অধ্যয়ন ও প্রিন্ট নেয়া যাবে।

মার্কসিস্ট ইন্টারনেট আর্কাইভে সংরক্ষিত ইংরেজী কপিটির সাথেও বাংলা ভাষান্তর মিলিয়ে দেখা হয়েছে।

এ রচনায় কমরেড মাও সেতুঙের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি

“মানুষের সঠিক চিন্তা কোথা থেকে আসে? সেগুলো কি আকাশ থেকে পড়ে?—না। সেগুলো কি মনের মধ্যে সহজাত?—তা নয়। মানুষের সঠিক চিন্তা কেবলমাত্র সামাজিক অনুশীলন থেকেই আসে। সমাজের উৎপাদন সংগ্রাম, শ্রেণীসংগ্রাম ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা—এই তিনটি অনুশীলন থেকেই সেগুলো আসে।”

“মানুষের সামাজিক অস্তিত্ব তার চিন্তাকে নির্ধারণ করে।”

“অগ্রগামী শ্রেণীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমূলক সঠিক চিন্তাকে জনসাধারণ একবার আয়ত্ব করে নিতে পারলেই এই চিন্তা বস্তুগত শক্তিতে পরিণত হয়, যা সমাজকে পুনর্গঠন করে আর দুনিয়াকে রূপান্তরিত করে।”

“সামাজিক সংগ্রামে অগ্রগামী শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী শক্তিগুলো কখনো কখনো পরাজিত হয়, তাদের পরাজয়ের কারণ এ নয় যে তাদের চিন্তা ভুল, বরং তার কারণ এই যে সংগ্রামরত শক্তিগুলোর পারস্পরিক ভারসাম্যে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো যতটা শক্তিশালী, অগ্রগামী শক্তিগুলো আপাতত ততটা শক্তিশালী নয়, তাই তারা সাময়িকভাবে পরাজিত হয়, কিন্তু একদিন না একদিন তারা জয়ী হতে বাধ্য।”

সর্বহারাশ্রেণীর পক্ষে দুনিয়াকে জানার উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধুমাত্র দুনিয়াকে রূপান্তরিত করা, এ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য নেই।”

একটা সঠিক জ্ঞান প্রায়শই বস্তু থেকে চেতনায় আর চেতনা থেকে বস্তুতে, অর্থাৎ অনুশীলন থেকে জ্ঞানে আর জ্ঞান থেকে অনুশীলনে অনেকবার পুনরাবৃত্তির পরেই কেবল আয়ত্ত করা যায়। এটাই হচ্ছে মার্কসবাদের জ্ঞানতত্ত্ব, অর্থাৎ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্ব।”

 “বস্তু  চেতনায় আর চেতনা বস্তুতে রূপান্তরিত হতে পারে”

“আমাদের কমরেডদেরকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্বে শিক্ষিত করে তোলা প্রয়োজন, যাতে করে তাঁরা সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারেন, অনুসন্ধান ও অধ্যয়নে ভাল হতে পারেন, অভিজ্ঞতার সার সংক্ষেপ করতে পারেন, দুঃখকষ্ট অতিক্রম করতে পারেন, কম ভুল করতে পারেন, কাজ ভালভাবে করতে পারেন, কঠোরভাবে সংগ্রাম করতে পারেন, চীনকে এক মহান শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন, বিশ্বের নিপীড়িত ও শোষিত ব্যাপক জনগণকে সাহায্য করতে পারেন আর এইভাবে আমাদের উপর অর্পিত মহান আন্তর্জাতিকতাবাদী কর্তব্য সম্পাদন করতে পারেন”                  

বাংলা ভাষান্তরের ভূমিকা

এই ছোট রচনাটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এতে বস্তুবাদী জ্ঞানতত্ত্ব অল্প কথায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মাও সেতুঙ দেখিয়েছেন মানুষের মস্তিষ্কে বস্তু জগতের প্রতিফলন এক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে। মানুষ যখন প্রকৃতির পরিবর্তন করতে যায় অর্থাৎ উৎপাদনে নিযুক্ত হয়, সেটা একটা সংগ্রাম। এই সংগ্রাম প্রকৃতির সাথে সংগ্রাম। এই সংগ্রামে সে জানতে পারে কীভাবে ফসল উৎপাদন করা যায় প্রকৃতির অনুকূল শক্তিগুলিকে ব্যবহার করে আর প্রকৃতির প্রতিকূল শক্তিগুলিকে মোকাবেলা করে। দ্বিতীয়ত, সমাজে শোষণের উদ্ভব ঘটার পর শ্রেণীতে শ্রেণীতে যে সংগ্রাম বেঁধে গেল, সেখান থেকে মানুষ জ্ঞান অর্জন করতে লাগল কীভাবে বৈর শ্রেণীকে পরাজিত করে উৎপাদন ব্যবস্থায় নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়, তৃতীয়ত বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন ও অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ তত্ত্ব তথা সাধারন নিয়ম কানুন জানতে পারে যা তার শ্রেণীসংগ্রাম ও উৎপাদন সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়, কেবল ঐ নিয়মকে বারংবার প্রয়োগের মাধ্যমে অধিক সঠিক নিয়ম, সূত্র, তত্ত্ব তৈরি হয়। ১ম উলম্ফনটি হচ্ছে অনুশীলন থেকে জ্ঞান অর্থাৎ চিন্তা। দ্বিতীয় উলম্ফন চেতনা বা চিন্তাকে আবার বস্তুর রূপান্তরে প্রয়োগ করার মাধ্যমে হয়। এভাবে বহুবার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে একটি সঠিক চিন্তা গড়ে উঠে। কমরেড মাও বলেনঃ একটা সঠিক জ্ঞান প্রায়শই বস্তু থেকে চেতনায় আর চেতনা থেকে বস্তুতে, অর্থাৎ অনুশীলন থেকে জ্ঞানে আর জ্ঞান থেকে অনুশীলনে অনেকবার পুনরাবৃত্তির পরেই কেবল আয়ত্ত করা যায়। এটাই হচ্ছে মার্কসবাদের জ্ঞানতত্ত্ব, অর্থাৎ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্ব।” তিনি আরো বলেনঃ “সর্বহারাশ্রেণীর পক্ষে দুনিয়াকে জানার উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধুমাত্র দুনিয়াকে রূপান্তরিত করা, এ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য নেই।”

কেন্দ্রীয় অধ্যয়ন গ্রুপ

বাংলাদেশের সাম্যবাদী পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী

৮ই জুন, ২০২৩

 

মানুষের সঠিক চিন্তা কোথা থেকে আসে?

মে, ১৯৬৩

মানুষের সঠিক চিন্তা কোথা থেকে আসে? সেগুলো কি আকাশ থেকে পড়ে?—না। সেগুলো কি মনের মধ্যে সহজাত?—তা নয়। মানুষের সঠিক চিন্তা কেবলমাত্র সামাজিক অনুশীলন থেকেই আসে। সমাজের উৎপাদন সংগ্রাম, শ্রেণীসংগ্রাম ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা—এই তিনটি অনুশীলন থেকেই সেগুলো আসে। মানুষের সামাজিক অস্তিত্ব তার চিন্তাকে নির্ধারণ করে। অগ্রগামী শ্রেণীর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যমূলক সঠিক চিন্তাকে জনসাধারণ একবার আয়ত্ব করে নিতে পারলেই এই চিন্তা বস্তুগত শক্তিতে পরিণত হয়, যা সমাজকে পুনর্গঠন করে আর দুনিয়াকে রূপান্তরিত করে। মানুষ তাদের সামাজিক অনুশীলনে বিভিন্ন ধরনের সংগ্রামে লিপ্ত হয় আর সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা অর্জন করে—সফলতার অভিজ্ঞতা আর বিফলতার অভিজ্ঞতা উভয়ই। বাস্তবমুখী বহির্জগতের অসংখ্য ঘটনা মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয় চোখ, কান, নাক, জিহবা ও চামড়ার মাধ্যমে তার মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হয়। প্রথমে জ্ঞান হচ্ছে ইন্দ্রিয় জ্ঞান। যখন এই ধরনের ইন্দ্রিয়-জ্ঞান যথেষ্ট পরিমাণে সঞ্চিত হয় তখন একটা উলম্ফন ঘটে আর তা ধারণাত্মক জ্ঞানে পরিবর্তিত হয়—এটাই হচ্ছে চিন্তা। এটা হচ্ছে জ্ঞানের একটা প্রক্রিয়া। এটাই হচ্ছে জ্ঞানের গোটা প্রক্রিয়ার প্রথম পর্যায় অর্থাৎ বাস্তব পদার্থ থেকে আত্মমুখী চেতনায়, অস্তিত্ব থেকে চিন্তায় চালিত হবার পর্যায়। এই পর্যায়ে চেতনা বা চিন্তা (তত্ত্ব, কর্মনীতি, পরিকল্পনা ও পদ্ধতিসহ) বাস্তব বহির্জগতের নিয়মগুলিকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করে কিনা তা এখনো প্রমাণিত হয়নি, সেগুলো সঠিক বা ভুল তা নির্ধারণ করা এখনো সম্ভব নয়। তারপর আসে জ্ঞানের প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় পর্যায়, অর্থাৎ চেতনা থেকে বস্তুতে, চিন্তা থেকে অস্তিত্বে চালিত হবার পর্যায়। এই পর্যায়ে, প্রথম পর্যায়ের অর্জিত জ্ঞানকে সামাজিক অনুশীলনে প্রয়োগ করা হয় আর তত্ত্ব, কর্মনীতি, পরিকল্পনা, পদ্ধতি ইত্যাদি প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করে কিনা তা নির্ণয় করা যায়। সাধারণভাবে বলতে গেলে, যা সফল হয় তা সঠিক, আর যা ব্যর্থ হয় তা ভুল, বিশেষ করে প্রকৃতির সাথে মানুষের সংগ্রামে এটা সত্য। সামাজিক সংগ্রামে অগ্রগামী শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী শক্তিগুলো কখনো কখনো পরাজিত হয়, তাদের পরাজয়ের কারণ এ নয় যে তাদের চিন্তা ভুল, বরং তার কারণ এই যে সংগ্রামরত শক্তিগুলোর পারস্পরিক ভারসাম্যে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো যতটা শক্তিশালী, অগ্রগামী শক্তিগুলো আপাতত ততটা শক্তিশালী নয়, তাই তারা সাময়িকভাবে পরাজিত হয়, কিন্তু একদিন না একদিন তারা জয়ী হতে বাধ্য। অনুশীলনের পরীক্ষার মাধ্যমে মানুষের জ্ঞানের আর একটা উলম্ফন ঘটে। এই উলম্ফনের গুরুত্ব আগেরটির চেয়ে বেশি। কারণ, কেবলমাত্র এই উলম্ফনই জ্ঞানের প্রথম উলম্ফনের ভুল অথবা সঠিকতাকে অর্থাৎ বাস্তব বহির্জগতের প্রতিফলনের প্রক্রিয়ায় অর্জিত চিন্তা, তত্ত্ব, কর্মনীতি, পরিকল্পনা ও পদ্ধতি ইত্যাদির ভুল অথবা সঠিকতাকে প্রমাণ করতে পারে। সত্যকে যাচাই করার এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। সর্বহারাশ্রেণীর পক্ষে দুনিয়াকে জানার উদ্দেশ্য হচ্ছে শুধুমাত্র দুনিয়াকে রূপান্তরিত করা, এ ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য নেই।

একটা সঠিক জ্ঞান প্রায়শই বস্তু থেকে চেতনায় আর চেতনা থেকে বস্তুতে, অর্থাৎ অনুশীলন থেকে জ্ঞানে আর জ্ঞান থেকে অনুশীলনে অনেকবার পুনরাবৃত্তির পরেই কেবল আয়ত্ত করা যায়। এটাই হচ্ছে মার্কসবাদের জ্ঞানতত্ত্ব, অর্থাৎ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্ব। আমাদের কমরেডদের মধ্যে অনেকেই এখনো এই জ্ঞানতত্ত্বকে বোঝেননা। তাঁদের চিন্তা, মতামত, কর্মনীতি, পদ্ধতি, পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত, অনর্গল বক্তৃতা আর দীর্ঘ প্রবন্ধগুলি কোথা থেকে আসে এ কথা জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা এ প্রশ্ন অদ্ভূত বলে মনে করেন এবং উত্তর দিতে পারেননা। বস্তু যে চেতনায় আর চেতনা যে বস্তুতে রূপান্তরিত হতে পারে এই রকম উলম্ফনের ঘটনা দৈনন্দিন জীবনে প্রায়ই দেখা গেলেও তাঁরা বুঝতে অক্ষম। সুতরাং, আমাদের কমরেডদেরকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্বে শিক্ষিত করে তোলা প্রয়োজন, যাতে করে তাঁরা সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারেন, অনুসন্ধান ও অধ্যয়নে ভাল হতে পারেন, অভিজ্ঞতার সার সংক্ষেপ করতে পারেন, দুঃখকষ্ট অতিক্রম করতে পারেন, কম ভুল করতে পারেন, কাজ ভালভাবে করতে পারেন, কঠোরভাবে সংগ্রাম করতে পারেন, চীনকে এক মহান শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন, বিশ্বের নিপীড়িত ও শোষিত ব্যাপক জনগণকে সাহায্য করতে পারেন আর এইভাবে আমাদের উপর অর্পিত মহান আন্তর্জাতিকতাবাদী কর্তব্য সম্পাদন করতে পারেন।।