১৯৭১ এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে পেয়ারাবাগান ঘাঁটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য

পেয়ারাবাগান ঘাঁটির ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন পোস্টার

পেয়ারাবাগান ঘাঁটির ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন পোস্টার

“১৯৭১ সালের ৩০শে এপ্রিল বরিশালের পেয়ারা বাগানে (বরিশাল সদর, বানারীপাড়া, ঝালকাঠি, কাউখালি, স্বরূপকাঠি থানার সীমান্তবর্তী আটঘর, কুড়িয়ানা, ভীমরুলী, ডুমুরিয়া এবং অন্যান্য গ্রাম) পূর্ববাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি সংগঠন পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বে একটি নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠে।
এভাবে পূর্ববাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম সর্বহারা বিপ্লবীদের নেতৃত্বে একটি নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠে।
কমরেড সিরাজ সিকদারের সরাসরি পরিচালনায় ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ বাহিনী গড়ে উঠে। এ সশস্ত্র বাহিনী এমন একটি সময় গড়ে উঠে যখন পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের প্রচণ্ড রণনৈতিক আক্রমণের মুখে আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের সকল প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে, তারা পূর্ববাংলার জনগণকে অসহায় অবস্থায় রেখে গা বাঁচানোর জন্য ভারতে পলায়ন করে।
পূর্ববাংলায় পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের প্রতিরোধ করার মতো কোন শক্তিই তখন অবশিষ্ট ছিল না।
এ সময় পেয়ারা বাগানের মুক্তি বাহিনী বীরত্বের সাথে পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে এবং পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে বিরাট প্রতিরোধ গড়ে তোলে, বিশাল এলাকা মুক্ত করে ঘাঁটি এলাকা স্থাপন করে, সশস্ত্র সংগ্রাম, জনগণকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করে, জনগণের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনে।
এ সশস্ত্র সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় ৩রা জুন, ১৯৭১ সালে গড়ে উঠে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি।’

[সিরাজ সিকদার রচনা ও পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির দলিলঃ পূর্ববাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার কতিপয় সমস্যা (৩০ এপ্রিল ১৯৭৪)]

“পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ববাংলার জনগণ জেগে ওঠেন ১৯৫২র ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ আন্দোলন থেকে ৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি জনগণের সংগ্রামসমূহকে সঠিক লাইনে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্রুশ্চভীয় সংশোধনবাদ আবির্ভূত হলে উক্ত পার্টি সংশোধনবাদী পার্টিতে পরিণত হয়। এর বিরুদ্ধে চেয়ারম্যানের মাওয়ের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সংগ্রাম সূচিত হলে ঐ পার্টি মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী এই দুই ধারায় বিভক্ত হয়। পিকিংপন্থী ধারাটি সংশোধনবাদ থেকে মুক্ত হতে পারেনা। সংশোধনবাদের এই শেকলকে ভেঙে ফেলেন কমরেড সিরাজ সিকদার।

সিরাজ সিকদার হচ্ছেন বাংলাদেশের মহানতম সন্তান যিনি এখানে সর্বহারা শ্রেণীকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিকাশ হিসেবে মাও চিন্তাধারাকে হাতে তুলে নিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই ভিত্তিতে তিনি সঠিকভাবে পূর্ববাংলার সমাজকে ঔপনিবেশিক-আধা সামন্তবাদী হিসেবে বিশ্লে­ষণ করেন এবং সর্বহারা শ্রেণীকে নেতৃত্ব দেন তাঁর নিজ পার্টি গড়ে তুলতে, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তাঁর বাহিনী গড়ে তোলায়, কৃষক, মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও জাতীয় বুর্জোয়াশ্রেণীকে সমাবেশিত করার মাধ্যমে য্ক্তুফ্রন্ট গঠনে, ঘাঁটি অঞ্চলসমূহ গড়ে তোলায়। তিনি সর্বহারা শ্রেণীকে জাতীয় ও শ্রেণীর মুক্তির লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। সভাপতি সিরাজ সিকদার এদেশে গণযুদ্ধ সুচিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।” [সিপিএমএলএম বাংলাদেশ-এর ঘোষণা ও কর্মসূচি, ১ মে ২০১২]

গত ২ ডিসেম্বর ঢাকায় উদযাপিত হয়েছে পেয়ারাবাগান ঘাঁটির ৫০-তম বর্ষপূর্তি। এ উপলক্ষে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।

২ডিসেম্বর ২০২১ পেয়ারাবাগান ঘাঁটির ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন ঢাকায়

২ডিসেম্বর ২০২১ পেয়ারাবাগান ঘাঁটির ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন ঢাকায়

 

চিন্তাধারা ও গণযুদ্ধ

সিরাজ সিকদারেরে চিন্তাধারার সাথে তার নেতৃত্বের অধীনে পার্টি পরিচালিত গণযুদ্ধ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটা চিন্তাধারা বিপ্লবের বাস্তব অবস্থায় উদ্ভূত হয় আর গণযুদ্ধের মধ্যে বিকশিত হয়। সিরাজ সিকদার প্রথমে ১৯৬৭ সালে মাওচিন্তাধারা গবেষণাগার করেছিলেন। এখান থেকে তার চিন্তাধারার গড়ে ওঠা শুরু হয়। তারপর ১৯৬৮ সালে পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন গঠন ও এর থিসিস প্রদান করা হয়, ১৯৭০ এ সশস্ত্র আক্রমণের মাধ্যমে গণযুদ্ধের সূচনা ঘটানো হয় অতঃপর ১৯৭১ এ ঘাঁটি এলাকা গড়ে তোলা হয়। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদকে পূর্ববাংলার বাস্তব অবস্থায় প্রয়োগের মাধ্যমে তার চিন্তাধারা গড়ে উঠেছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে মতাদর্শ হিসেবে ঘোষণা করে, জাতীয় সংগ্রামের পর্যায়কে প্রধান গুরুত্বে তুলে ধরে, মস্কো ও পিকিংপন্থী দাবিদার সকল বামপন্থী গ্রুপগুলির ভ্রান্ত তত্ত্বগুলোকে খণ্ডন করে যেগুলো কমিউনিস্ট নেতৃত্বে উপনিবেশবাদবিরোধী জাতীয় যুদ্ধের মাধ্যমে গণযুদ্ধ গড়ে তোলার ধারণাকে বিরোধিতা করছিল। গণযুদ্ধের মাধ্যমেই আবার এই চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে। এই দুই জিনিস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণঃ চিন্তাধারা ও তার প্রয়োগ। সুতরাং পেয়ারাবাগান ঘাঁটি এক সুপরিকল্পিত ঘটনা, এক মহান চিন্তাধারার বাস্তব প্রয়োগ। এই চিন্তাধারা কোন ব্যক্তির মস্তিষ্কপ্রসূত নয়, বরং এক সমাজ বাস্তবতা এর জন্ম দিয়েছে, যার মধ্যে পরিবর্তনের উপাদান জন্ম নিয়েছে। সুতরাং সিসির চিন্তাধারা কোন ব্যক্তির চিন্তাধারা নয়, এটা এক অগ্রসর মতবাদ। এর বাইরে স্বতস্ফূর্ত বিভিন্ন বক্তব্য, ততপরতা যতই থাকুক তা কোন চিন্তাধারা নয়, তা কোন মার্কসবাদী দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পদ্ধতিতে উদ্ভূত হয়নি, তা কোন সুপরিকল্পিত নয়, তা সহজে ধ্বসে যায়। আর সুপরিকল্পিত সুচিন্তিত কোন জিনিস যা একটি সমগ্র প্রণালী হিসেবে আবির্ভূত হয় তা ধ্বংস হয়ে যায়না, বরং বারবার তা আবির্ভূত হয়।

পেয়ারাবাগানের সাথে তাই অন্য কোন কিছুর তুলনা হতে পারেনা। এটা এক চিন্তাধারা উদ্ভূত। আমাদের ইতিহাসে এই ঐতিহ্য গৌরবময় ও মহান। বাংলাদেশে কমিউনিস্টদের নতুন চিন্তাধারার আলোকে পেয়ারাবাগান বাস্তবিক বারবার আবির্ভূত হবে।।