ভাইরাসঃ বিশ্ব পুঁজিবাদের সাধারণ সংকট

ভাইরাস হচ্ছে ক্ষুদ্রতম জীব। পৃথিবীর জন্মের কিছুকাল পর বায়োস্ফেয়ারের জন্ম হয়। এটা পৃথিবীর পৃষ্ঠে এমন এক স্তর যেখানে জীবনের উদ্ভবের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পানি, কার্বন ইত্যকার পদার্থ তৈরি হয়েছে। কিছুকালের মধ্যেই আপাত জড় থেকে জীবের অন্তরবর্তী সত্ত্বা রাইবোনিউক্লিক এসিড (আরএনএ) জন্ম নিল। এটাই ভাইরাসে্র আদি রূপ। এরাই পৃথিবীর প্রথম জীবন। এরা ছিল নিজের অনুলিপি তৈরি করতে সক্ষম। পুরো পৃথিবী ছিল তাদের। একে বলা হয আরএনএ দুনিয়া। বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় এই আরএনএ ভাইরাসের অনেকে প্রোটিনের আবরণ তৈরি করল, আবার অনেকে সেইসাথে লিপিডের আবরণও তৈরি করল। বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় অনেক আরএনএ ডিএনএ (ডিঅক্সি রাইবোনিউক্লিক এসিড) তে পরিণত হল। এভাবে আরএনএ ভাইরাস থেকে ডিএনএ ভাইরাস উদ্ভূত হল। ভাইরাসের মধ্যে আরএনএ ভাইরাসই সংখ্যাধিক। ডিএনএর উদ্ভবে্র পর বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় এককোষী জীব যথা ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হল। এককোষী থেকে বহুকোষী, সবুজ উদ্ভিদ এবং অতপর প্রাণী বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে। আজকে আমরা দেখি ভাইরাসের মধ্যে জড় ও জীবের উভয়ের বৈশিষ্ট্যই বিরাজমান। কিন্তু এর গতি জীবের দিকে। পোষক কোষের বাইরে সে জড়বস্তু্র মত থাকে। পোষক কোষের ভিতরে ঢুকে সে সক্রিয় জীবন প্রদর্শন করেঃ কোষের মেকানিজমকে কাজে লাগিয়ে অনবরত নিজ অনুলিপি তৈরি করতে থাকে।

সমস্ত জীবজগতে ভাইরাসরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমরা যখন হা করি আমাদের মুখের ভেতর কোটি কোটি ভাইরাস ঢুকে যায়। এরা আমাদের ক্ষ্তি করেনা। সমুদ্রের এক চামচ পানিতে ১০/২০ লাখ থেকে ৯০ লাখ পর্যন্ত ভাইরাস থাকে। সাগরের নীচে সবুজ উদ্ভিদেরা যে অক্সিজেন উতপাদন করে তার উপর পৃথিবীর জীবজগত বহুলাংশে নির্ভরশীল শ্বসন চালানোর জন্য। আর এই অক্সিজেন উতপাদনে্র অন্তত ২৫% কাঁচামাল যোগান দেয় ভাইরাসে্রা ব্যাকটে্রয়াকে মেরে তার জৈব কার্বনকে অবমুক্ত করার মাধ্যমে। সুতরাং ভাইরাসের অস্তিত্বের উপর জীবের অস্তিত্ব অনেকাংশে নির্ভরশীল। মানুষের জিনোমের ৮% ভাইরাসের দ্বারা গঠিত হয়েছে। ডিম ফোঁটা থেকে বাচ্চা হওয়াতে বিবর্তিত হওয়ার মাধ্যমে স্তন্যপায়ীর উদ্ভব ভাইরাসই সম্ভব করে তুলেছেঃ মায়ের পেটে বাচ্চা যে প্লাসেন্টা্র মাধ্যমে খাদ্য ও অক্সিজেন মায়ের কাছ থেকে গ্রহণ করে আর কার্বন ডাই অক্সাইড ও বর্জ্য ত্যাগ করে তা ভাইরাসে্র দ্বারা গঠিত হয়েছে। প্লাসেন্টার প্রোটিন আর ভাইরাসে্র প্রোটিন একই। ভাইরাস জীবদেহের জন্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর অনেক ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে। সুতরাং মানুষের জন্য ও সেইসাথে জীবজগতের জন্য ভাইরাস অপরিসীম গুরুত্বুপূর্ন।

কিন্তু অনেক ভাইরাস মানুষের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যেমন বসন্ত, হাম, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এইডস, জন্ডিস, কোভিড১৯ ইত্যাদি। এগুলোর মাধ্যমে বিশ্বে কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে কোভিড১৯ এর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ইতিমধ্যে পৃথিবীতে পঞ্চাশ লক্ষের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। ভাইরাস এক প্রাকৃতিক শক্তি। এর ধ্বংস করা সম্ভব নয়। প্রকৃতির প্রতি হিংসাত্মক দৃষ্টিভংগী নিয়ে একে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আর এটাই পুঁজিবাদী সমাজের বর্তমান সাধারণ সংকট। পুঁজির আগ্রাসনে দুনিয়ার বন পরিবেশ উদ্ভিদ-প্রাণী তথা জীবজগত ধ্বংস হয়ে এই গ্রহটি ধ্বংসের মুখে পড়েছে। এখন হয় পৃথিবীকে বাঁচতে হবে নাহয় পুঁজিবাদকে বাঁচতে হবে। পৃথিবীর ৯৯ শতাংশ মানুষ পুঁজিবাদের পরিপূর্ণ ধ্বংস চান, কারণ পুঁজিবাদের ঐতিহাসিক প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়ারা আর ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে তাদের দোসররা ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে, ন্যুনতম স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারেনি, লক ডাউনের নামে ব্যাপক ক্ষুধা ও দারিদ্র সৃষ্টি করেছে, মানুষকে অনাহারে অর্ধাহারে রেখেছে, অধিকাংশ মানুষকে কোন জরুরী খাদ্য ও স্বাস্থ্য সেবা দেয়নি, অধিকাংশ মানুষকে টিকা দেয়নি। সুতরাং কোভিডের বিপদ এখনো বিরাজমান। এমন একটি সমাজ কাম্য হতে পারেনা যেখানে লাঞ্ছনা-বঞ্চনা নিত্যসংগী।

আর আমরা এটাও জানি যে সামনের দিন পুঁজিবাদের নয়, সাম্যবাদের যেখানে মানুষে-মানুষে শোষণ থাকবেনা, প্রকৃতি হবে মানুষের বন্ধু, শত্রু নয়।।

এ সম্পর্কিত পূর্বের নিবন্ধঃ

Sarbaharapath | বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস ও শোষকদের দৃষ্টিভংগী