সিরাজ সিকদার রচনাঃ কয়েকটি শ্লোগান প্রসঙ্গে

 

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার

 


পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ জানুয়ারি ১৯৭১

সিপিএমএলএম বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ৪ জানুয়ারি ২০১২


 

পিডিএফ

 

সঠিক রাজনীতি হচেছ পার্টির প্রাণ। ইহা নিজেকে প্রকাশ করে রাজনৈতিক রণনীতি ও রণকৌশলের মাধ্যমে। রণনীতি ও রণকৌশল শ্লোগানের মাধ্যমে জনসাধারণের সামনে উত্থাপন করা হয় এবং এর ভিত্তিতে জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রাম নামানো হয়।

দু ধরনের শ্লোগান রয়েছে–রণনীতিগত ও রণকৌশলগত। রণনীতিগত শ্লোগান হলো একটি রণনীতির প্রতিফলন; একটি রণকৌশলগত শ্লোগান হলো একটি রণকৌশলের প্রতিফলন। রণনীতি হলো একটি মৌলিক দ্বন্দ্বের সমাধান এবং রণকৌশল হলো একটি দ্বন্দ্বের স্তরের সমাধান। রণনীতি মৌলিক দ্বন্দ্বের মীমাংসার সামগ্রিক কাল পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকে, একারণে এটা দীর্ঘস্থায়ী। পক্ষান্তরে রণকৌশল অধিক পরিবর্তনশীল, কেননা একটি দ্বন্দ্বের বিকাশের প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত মীমাংসার পূর্ব পর্যন্ত বহু স্তর অতিক্রম করে এবং স্তর অনুযায়ী রণকৌশল রচিত হওয়ায় ইহাও পরিবর্তিত হয়।

সর্বহারারা বর্তমান পূর্ববাংলার সমাজে শ্রেণীগতভাবে সংখ্যালঘু এমনকি সমাজতান্ত্রিক সমাজেও একটি পর্যায় পর্যন্ত সংখ্যালঘু থাকবে। এ অবস্থায় সর্বহারারা কিভাবে দেশের সকল জনসাধারণকে নেতৃত্ব দেবে? প্রথমতঃ ঐতিহাসিক বিকাশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মৌলিক রাজনৈতিক শ্লোগান (রণনীতিগতলেখক) উত্থাপন করে এবং বিকাশের প্রতিটি স্তর ঘটনার প্রতিটি পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে কর্ম বিষয়ক শ্লোগান (রণকৌশলগত লেখক) উত্থাপন করে, যাতে রাজনৈতিক শ্লোগানগুলোকে বাস্তবায়িত করা যায় [১] কাজেই পূর্ববাংলার সর্বহারাদের পূর্ববাংলার সমাজের সকল জনসাধারণকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদান করতে হলে পূর্ববাংলার সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনৈতিক রণনীতি ও রণকৌশল এবং রণনীতি ও রণকৌশলের প্রতিফলন রণনীতিগত ও রণকৌশলগত শ্লোগান রচনা করতে ও তা কার্যকরী করতে হবে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে তাদেরকে অধ্যয়ন করতে হবে, বিশ্লেষণ করতে হবে পূর্ববাংলার বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীদের শ্লোগান পূর্ববাংলার সমাজ ও তার বিকাশকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করে কিনা।

 

জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা

মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাও সেতুঙ চিন্তানুসারী সর্বহারা বিপ্লবীদের বিশ্লেষণ থেকে এ শ্লোগান সঠিক; ইহা পূর্ববাংলার সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইহা দুটো দ্বন্দ্বের সমাধান—একটি হলো, বৈদেশিক শোষকদের সাথে পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব; অপরটি হলো সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্ব। প্রথমটির সমাধান হচ্ছে জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে, পরেরটির সমাধান হচ্ছে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবে দ্বন্দ্বের দুটো দিক—জাতীয় বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাঝে প্রধান দিক হলো জাতীয় বিপ্লব, এর কারণ পুর্ববাংলা একটি উপনিবেশ, সমগ্র জাতি উপনিবেশিক শোষণ ও শাসনে নিপীড়িত ও এর অবসান চায়। এই জাতীয় বিপ্লবের সমাধান হলো স্বাধীন, সার্বভৌম পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠা করা এবং ইহা সম্ভব জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।

কৃষক জনতার সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্বের সমাধান হচ্ছে গণতান্ত্রিক বিপ্লব অর্থাৎ, সামন্তবাদকে উৎখাত করে কৃষকের হাতে জমি প্রদান করা। সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্ব গৌন। এ কারণে ঐ সকল সামন্ত শক্তিকে খতম করতে হবে যারা জাতীয় বিপ্লবের শত্রু এবং এর বিরোধিতা করে।

আমাদের রণনীতি হলো জাতীয় দ্বন্দ্বের সমাধান—পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত করে স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠা করা এবং সকল প্রকার জাতীয় নিপীড়নের অবসান করা; সামন্তবাদকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত করে কৃষকের হাতে জমি প্রদান করা।

আমাদের রণকৌশলগত লাইন হলো জাতীয় স্বাধীনতা বিরোধী সামন্তশক্তিকে খতম করা।

হক-তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা শ্লোগানের বিশ্লেষণ হিসেবে যা উত্থাপন করে তার সাথে এ শ্লোগানের কোন সামঞ্জস্য নাই। এর ফলে ইহা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তারা এ শ্লোগানের ব্যবহার করেছে সর্বহারা বিপ্লবী ও জনসাধারণকে ভাওতা প্রদানের জন্য এবং আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া (সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ) ও তার দালাল আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীদের পদলেহী কুকুর হিসেবে কাজ করছে।

হক-তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদীরা পূর্ববাংলার জনগণের সাথে পাকিস্তানের উপনিবেশিক সামরিক শাসকগোষ্ঠীর জাতীয় দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব এবং এর সমাধান হিসাবে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সঠিক রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ না করে পূর্ববাংলার জমিদার শ্রেণীর সাথে কৃষক-জনতার দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব ও তার সমাধান হিসেবে কৃষি বিপ্লবের লাইন গ্রহণ করেছে। কৃষি বিপ্লব হলো পূর্ববাংলার সামন্ত জমিদার শ্রেণীর সাথে কৃষক জনতার গৃহযুদ্ধ, ইহা শ্রেণী সংগ্রাম। এভাবে তারা পূর্ববাংলার অভ্যন্তরস্থ শ্রেণীসংগ্রাম, গৃহযুদ্ধ, কৃষি বিপ্লবের কথা বলে, জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম অর্থাৎ, পূর্ববাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে, স্বাধীন গণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে পূর্ববাংলার জনগণকে দূরে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এভাবে তারা আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া দালাল এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের টিকিয়ে রাখার জন্য অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে।

সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্ব প্রধান হলে, পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ইহা অধিকতর সত্য। কাজেই পাকিস্তান ভিত্তিক সামন্তবাদের বিরুদ্ধে কৃষকের গৃহযুদ্ধ হওয়া উচিত ছিল “সামন্তবাদ প্রধান দ্বন্দ্ব”—এ বক্তব্যের প্রবক্তাদের কর্মসূচী। সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব ও তার সমাধান শ্রেণী যুদ্ধের প্রাক্কালে জাতীয় বিচ্ছিন্নতার প্রশ্ন গৌন এবং এই গৌন সংগ্রাম পরিচালনা করে প্রধান শ্রেণী সংগ্রাম ও শ্রেণী যুদ্ধকে ক্ষতিগ্রস্থ করা মার্কসবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ইহা বুর্জোয়া কৌশল। এ কারণে ভারতের মার্কসবাদী-লেনিনবাদীরা কোন একটি বিশেষ জাতীয় বিচ্ছিন্নতার জন্য লড়াই করছে না। আত্মনিয়ন্ত্রন অধিকার, অর্থাৎ, সকল জাতির নিপীড়নের অবসান, অর্থাৎ, গৌন জাতীয় দ্বন্দ্বের সমাধানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে বীরত্বের সাথে শ্রেণীসংগ্রাম আভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

হক-তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদীরা সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব, এর সমাধান কৃষিযুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ প্রভৃতি বলছে, একই সাথে জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা অর্থাৎ, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কোন এক পর্যায়ে পূর্ববাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার কথা বলছে। এটা প্রমান করে, তাদের শ্লোগান তাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। একটি অপরটির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।

মার্কসবাদীরা সর্বদা জাতিসমূহের শোষণ-নিপীড়নের ভিত্তিতে সংযুক্তির বিরোধিতা করে, পক্ষান্তরে শোষণ-নিপীড়নহীন সমতার ভিত্তিতে সংযুক্তিকে স্বাগত জানায়। ইহা উৎপাদনের বিকাশ, সামাজিক অগ্রগতি ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার জন্য সহায়ক। এ কারণে সামন্তবাদ প্রধান দ্বন্দ্ব হলে এ থেকে আসে পাকিস্তান ভিত্তিক বিপ্লব, পাকিস্তানের প্রতিটি জাতিকে আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার প্রদানের ভিত্তিতে জনগণতান্ত্রিক পাকিস্তান গঠন করা। সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্বকে প্রধান বলে উপরোক্ত কর্মসূচী ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ করা মার্কসবাদের পরিপন্থী এবং বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের প্রকাশ। কাজেই সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব বলে জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা বলা ভুল। “জনগণতান্ত্রিক পাকিস্তান”—এ বিশ্লেষনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

হক-তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদীরা জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার শ্লোগান কেন উত্থাপন করছে? এর কারণ, এরা স্বাধীন পূর্ববাংলার কথার টোপ ফেলে দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের গেঁথে তোলার জঘন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে যাতে তারা বিপ্লবীদের চেতনাকে হত্যা করে আজ্ঞাবহ পুতুল তৈরী এবং শেষ পর্যন্ত তাদেরকে নয়া সংশোধনবাদের ধারক বাহক হিসেবে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়।

হক-তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদীরা স্বাধীনতার কথা বলে। স্বাধীনতা কার কাছ থেকে? তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী সামন্তবাদ প্রধান শত্রু। অতএব স্বাধীনতা হচ্ছে সামন্তবাদের নিকট থেকে, অর্থাৎ, পূর্ববাংলার জমিদাররা পূর্ববাংলাকে পরাধীন করে রেখেছে। এই হাস্যস্পদ যুক্তি একটি স্কুল ছাত্রও গ্রহণ করবে না। ইহা প্রমাণ করে দালালী করতে করতে তারা কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।

আবার কখনও বলে তারা স্বাধীনতা চায় সাম্রাজ্যবাদের নিকট থেকে। সাম্রাজ্যবাদ পূর্ববাংলাকে শোষণ করছে, পশ্চিম পাকিস্তানকেও শোষণ করছে। যে কোন সর্বহারা সাম্রাজ্যবাদের নিকট থেকে স্বাধীনতা চায়, সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবসান চায়। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের নিকট থেকে স্বাধীন করে, অর্থাৎ, সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবসান করে পূর্ববাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করা কেন? স্বাধীন পাকিস্তান না করে স্বাধীন পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠা কেন? ইহা কি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ নয়?

হক-তোয়াহা, দেবেন-মতিন, কাজী-রণোরা এ সকল প্রশ্নের উত্তর হিসেবে উত্থাপন করে ভৌগলিক দূরত্বকে অর্থাৎ, বাহ্যিক কারণকে (পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ববাংলা ১২শত মাইল দুর)। বাহ্যিক কারণ ভৌগলিক ব্যবধানের ফলে যোগাযোগের অসুবিধা, আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগে ইহার সমাধান সম্ভব। পক্ষান্তরে পূর্ববাংলার অভ্যন্তরস্থ উত্তরবঙ্গ, খুলনা প্রভৃতি অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ করতে বার ঘন্টার অধিক সময় লাগে। ভৌগলিক দিক দিয়ে এ সকল অঞ্চলের ব্যবধান পশ্চিম পাকিস্তানের চাইতে অনেক কম হলেও যোগাযোগের দিক দিয়ে অনেক অসুবিধাজনক। হক-তোয়াহাদের যুক্তি মত এ সকল অঞ্চলসহ পূর্ববাংলার অন্যান্য দুর্গম-অঞ্চলের স্বাধীন হওয়া প্রয়োজন। ইহা আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের চিন্তাধারা নয়, মধ্যযুগীয় চিন্তাধারার প্রতিফলন যখন যোগাযোগের কারণে বিভিন্ন অঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো।

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আমাদের শিক্ষা দেয়, বস্তুর বিকাশের কারণ বাহ্যিক নয়, আভ্যন্তরীণ ইহা নিহিত রয়েছে বস্তুর অভ্যন্তরস্থ দ্বান্দ্বিকতার মধ্যে ইহা আরো শিক্ষা দেয়, সামাজিক বিকাশের মৌলিক কারণ হলো সমাজের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব অর্থাৎ, পূর্ববাংলার সমাজের বিকাশের পরিণতি স্বাধীন গণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা হওয়ার মৌলিক কারণ পূর্ববাংলার সমাজের অভ্যন্তরস্থ; ইহা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী। হক-তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদীরা অন্যান্য সংশোধনবাদীদের সাথে পূর্ববাংলার সামাজিক বিকাশের পরিণতি স্বাধীন গণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা হওয়ার কারণকে বাহ্যিক, অর্থাৎ, ভৌগলিক দূরত্বকে উল্লেখ করে নিজেদের আধিবিদ্যক বিশ্বদৃষ্টিকোণের প্রকাশ করেছে। সভাপতি মাও এদের সম্পর্কে বলেছেন, এরা (আধিবিদ্যকরালেখক) সামাজিক বিকাশের কারণ হিসেবে সমাজের বাইরের শক্তিকে উল্লেখ করে যেমন ভৌগলিক অবস্থা (ভৌগলিক দূরত্ব তার মাঝে একটি) এদের সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন “… …ইহা (আধিবিদ্যক বিশ্বদৃষ্টিকোণ লেখক) বহুদিন ধরে সমর্থন পেয়ে আসছে ক্ষয়ীষ্ণু সামন্তবাদী শাসকগোষ্ঠী দ্বারা, বর্তমানে সমর্থন পাচ্ছে বুর্জোয়াদের অর্থাৎ এই প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী বিশ্বদৃষ্টিকোণ আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া ও তাদের দালাল এবং দেশীয় বুর্জোয়া ও সামন্ত জমিদার গোষ্ঠীর…সহায়তা  করছে। হক-তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদীরা কৃষকের সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব, তার সমাধান শ্রেণীযুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ প্রভৃতি সংগ্রামের নামে পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় বিচ্ছিন্নতার সংগ্রামকে বিরোধীতা করছে এবং পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর প্রধান সমস্যা পূর্ববাংলার বিচ্ছিন্নতা ঠেকানোর প্রচেষ্টায় সামিল হয়েছে। তারা পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর ঝটিকা বাহিনী হিসেবে কাজ করছে। তারা বিপ্লবী শ্লোগানের আড়ালে প্রতিক্রিয়ার প্রচারযন্ত্র হিসেবে কাজ করছে। এ কারণে তাদের পত্রিকা পুস্তকাদি প্রকাশ্যে বাজারে বিক্রীর জন্য সরকারী আনুকূল্য পাচ্ছে।

এভাবে পাকিস্তানের উপনিবেশিক সরকার যা পারছে না তাই তারা করছে। পূর্ববাংলার বিপ্লবী জনগণকে উপকারী সেজে ভাওতা দিচ্ছে। এভাবে তারা পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী যাদের শ্রেণীভিত্তি হলো আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ, তাদের পদলেহী কুকুর হিসেবে কাজ করছে।

তারা পূর্ববাংলার উপর উপনিবেশিক শাসন ও নিপীড়নের বিরোধিতা না করে পুর্ববাংলার জনগণকে ছয়দফা-বুর্জোয়াদের পিছনে ঠেলে দিচ্ছে।

হক-তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদীরা কিছু দিন পূর্বেও সর্বহারার রাজনৈতিক লাইন নির্ণয়ের প্রশ্নে প্রধান দ্বন্দ্ব খুঁজে বের করার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করেছে এবং সকল দ্বন্দ্বকে এক ও অবিচ্ছেদ্য বলেছে। হক তার “আধাউপনিবেশিক আধাসামন্তবাদী পূর্ববাংলা” পুস্তকে  লিখেছে (৫৮ পাতা – লেখক) এই তিন শক্তি (সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, একচেটিয়া পুঁজিবাদ লেখক) হইল এক অবিচ্ছিন্ন শক্তি……আজ আমাদের দেশের প্রধান মৌলিক বিরোধ হইল, একদিকে জনগণ আর অন্যদিকে এই তিন শক্তির প্রকাশ সে আরো বলেছে, এই তিন শক্তির অবিচ্ছিন্ন সত্ত্বাকে পৃথকভাবে বিচার করার অর্থই হলো ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবেই হউক ইহাদের স্বার্থের ওকালতি করা, ইহাদের স্বার্থে কাজ করা

সহজ ও সাধারণ কথায় ইহা অধিবিদ্যা ও ভাববাদ, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পরিপন্থী যা আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া, এদেশীয় বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীদের সহায়তা করে। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আমাদের শিক্ষা দেয়—বস্তু আমাদের চেতনা থেকে স্বাধীনভাবে বিরাজ করে। বস্তু প্রাথমিক, চেতনা হচ্ছে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মস্তিষ্কে বস্তুর প্রতিফলন। চেতনা বস্তুসৃষ্ট, গৌণ। ইহা আরো শিক্ষা দেয় যে, বস্তু গতিশীল, এ গতির নিজস্ব নিয়মবিধি রয়েছে। বস্তুর বিকাশের প্রক্রিয়ায় যদি অনেকগুলো দ্বন্দ্ব থাকে তবে প্রতিটি দ্বন্দ্বের আলাদা অস্তিত্ব রয়েছে, আবার পরস্পর সম্পর্কও রয়েছে এবং বস্তু বিকাশ লাভ করে পর্যায়ক্রমে দ্বন্দ্বসমুহের প্রধান দ্বন্দ্ব মীমাংসার মাধ্যমে। বস্তু বিকাশের এই নিয়মের প্রতিফলনই সন্নিবেশিত হয়েছে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও প্রধান দ্বন্দ্বের নিয়মে।

হক বস্তুর বিকাশের নিয়মকে প্রতিফলিত না করে তার মাথা থেকে বস্তু বিকাশের নিয়ম নির্দেশ করেছে, এভাবে সে চেতনাকে দিচ্ছে প্রাথমিক ভূমিকা এবং বস্তুকে অধীনস্থ ভূমিকা। ইহা পরিষ্কার ও স্পষ্ট ভাববাদ। এভাবে তারা শত্রুকে বিচ্ছিন্ন করে এক এক করে ধ্বংস করা থেকে জনগণকে বিরত করে শত্রুকে রক্ষা করছে। সর্বহারার মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রাক্কালে ‘সকল কেডারকে আক্রমণ কর’–এ শ্লোগান দ্বারা লিউশাউচি, তাউচু প্রভৃতি সংশোধনবাদী প্রতিবিপ্লবীরা সর্বহারা বিপ্লবীদের বিভ্রান্ত করে মুষ্টিমেয় সংশোধনবাদীদের রক্ষা করতে চেষ্টা করেছিল। ইহা একটি অতিশয় পুরোনো কৌশল।

এক পর্যায়ে তারা জনগণতান্ত্রিক পূর্ব পাকিস্তান বলতো। অকস্মাৎ তারা সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব এবং জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা বলা শুরু করে।

প্রধান দ্বন্দ্ব ও জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার কথা বলে বলে কি তারা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী হয়েছে? না। অতীতে তাদের ভাববাদ ও অধিবিদ্যা ছিল প্রকাশ্য ও স্থূল, তাই সহজেই ধরা পড়তো। কিন্তু বর্তমানে তা হয়েছে অধিকতর গোপন ও সূক্ষ। কী কী অবস্থার উদ্ভব হয়েছে যার ফলে হক-তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদীদের কৌশলে পরিবর্তন এসেছে, তাদের বদমাইশীকে অধিকতর সূক্ষ ও গোপন করেছে?

ইহা হলো ভারতীয় বিপ্লবে চারু মজুমদার, কানু স্যানালের নেতৃত্বে মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের বিজয় এবং নাগি-রেড্ডি, জ্যোতি-নাম্বুদ্রিপাদের পরাজয় এবং পূর্ববাংলার সর্বহারা বিপ্লবীদের ওপর তার প্রভাব, পূর্ববাংলার জাতীয় চেতনায় তীব্রতা।

হক-তোয়াহা নয়া সংশোধনবাদীরা প্রথমে নকশালবাড়ী কৃষক বিদ্রোহকে বিরোধীতা করে একে সি,আই,এর ষড়যন্ত্র (জ্যোতি-নাম্বুদ্রিপদের বক্তব্য – লেখক) বলে আখ্যায়িত করে। জ্যোতি-নাম্বুদ্রিপদের পরাজয়ের পরে তারা রাতারাতি তাদের বক্তব্য পাল্টিয়ে নাগী-রেড্ডীকে প্রকৃত নক্সালপন্থী হিসেবে সমর্থন করে। কিন্তু নাগী-রেড্ডীর প্রকৃত নয়া সংশোধনবাদী চরিত্র প্রকাশ হওয়ায় তারা নিজেদেরকে রক্ষা ও জনগণকে ভাওতা প্রদানের জন্য নিজেরা নক্সালপন্থী বনে যায়। এরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের জীবন্ত আত্মা, বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণকে বিসর্জন দিয়ে ভারতীয় মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের ভারতীয় বিশেষ অবস্থার জন্য রচিত কর্মসূচী–সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্ব ও তার সমাধান কৃষি বিপ্লব গ্রহণ করে। তারা নিভৃতে জনগণতান্ত্রিক পূর্ব পাকিস্তান বিসর্জন দিয়ে জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা গ্রহণ করে।

অতীতে তারা তিন শত্রুকে এক ও অবিচ্ছেদ্য বলে পর্যায়ক্রমে একটি একটি শত্রুকে ধ্বংস করা থেকে জনগণকে বিরত করেছে। বর্তমানে তারা গৌণ শত্রু সামন্তবাদকে প্রধান শত্রু হিসেবে আক্রমণের কথা বলে শেষ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে প্রধান শত্রু পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীকে রক্ষা করার জন্য।

 

স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা

ট্রটস্কি-চেবাদী দেবেন-মতিনদের এই শ্লোগান প্রমাণ করে তারা জনগণতন্ত্রের অর্থ বুঝে না এবং স্বাধীনতার সাথে জনগণতন্ত্রের সম্পর্কের বিষয়েও তাদের কোন জ্ঞান নাই। তত্ত্বের দিক দিয়ে এরা বুদ্ধু, এ কারণে এদের ভাওতা নয়া সংশোধনবাদীদের তুলনায় স্থুল ও প্রকাশ্য।

অতীতে তারা জোতদার মহাজনদের জমিদার শ্রেণীভুক্ত না করে তাদেরকে ধনী চাষীর পর্যায়ে ফেলেছে এবং সরকারী খাজনা-ট্যাক্সের সামন্তবাদী শোষণ অস্বীকার করেছে এবং পূর্ববাংলার উপর পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর শোষণকে জাতীয় বুর্জোয়া শোষণ বলেছে, সাম্রাজ্যবাদী শোষণকে কমিয়ে দিয়ে পূর্ববাংলার সমাজকে ধনতান্ত্রিক সমাজে পরিণত করেছিল। [২] তাদের এই আত্মগত বিশ্লেষণ প্রমাণ করার জন্য পচা গলা আবর্জনা দ্বারা তারা পুস্তকের পর পুস্তক ভরে তুলেছিল এবং মানুষের ধৈর্য্যের ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল।

অতীতের মত বর্তমানেও তারা সবকিছু তালগোল পাকিয়ে নিজেদেরকে হাস্যস্পদ করেছে এবং নিজেদের যে মার্কসবাদের ক-খ-গ-এর জ্ঞান নেই তা প্রমাণ করেছে।

জনগণতন্ত্র হলো নয়া গণতন্ত্র, অর্থাৎ, সামন্তবাদী বা আধা-সামন্তবাদী, উপনিবেশিক বা আধা উপনিবেশিক সমাজে বুর্জোয়া বিকাশের বাধা বৈদেশিক বুর্জোয়াদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং আভ্যন্তরীণ সামন্তবাদের প্রতিবন্ধকতা শ্রমিক শ্রেনীর নেতৃত্বে উৎখাত করে পুঁজিবাদ বিকাশের শর্ত সৃষ্টি করা। ইহা শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এই বিপ্লবকে যদি আমরা দ্বন্দ্ব ধরি তবে এর দুটো দিক রয়েছে–একটি হলো জাতীয় বিপ্লব, অন্যটি হলো গণতান্ত্রিক বিপ্লব। জাতীয় বিপ্লবের উদ্দেশ্য হলো বৈদেশিক বুর্জোয়াদের উৎখাত করে পূর্ববাংলা স্বাধীন করা এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের উদ্দেশ্য হলো সামন্তবাদকে উৎখাত করা।

কাজেই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাঝেই স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত। জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার আগে স্বাধীন শব্দটি ব্যবহার তাত্ত্বিক অজ্ঞতার পরিচয়।

জনগণতান্ত্রিক তথা নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দুটো দিক–জাতীয় বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাঝে সামাজিক বিকাশের প্রক্রিয়ায় কখনো জাতীয় বিপ্লব প্রধান দিক হয়, আবার কখনও গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রধান হয়।

চীনদেশে ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রধান দিক ছিল। ১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় বিপ্লব প্রধান দিক ছিল, ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত পুনরায় গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রধান দিক ছিল। ভারতের সামাজিক বিকাশের পর্যায়ে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রধান দিক হলো গণতান্ত্রিক বিপ্লব, অর্থাৎ, সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব। পক্ষান্তরে, সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের সাথে ভারতীয় জনগণের দ্বন্দ্ব গৌণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে।

মতিন-দেবেন ট্রটস্কি-চেবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র যারা জন্মলাভ করেছে নয়া সংশোধনবাদীদের গর্ভ থেকে, তারা বজায় রেখেছে নয়া সংশোধনবাদীদের ভাববাদী আধিবিদ্যক দৃষ্টিকোণ। পূর্ববাংলাভিত্তিক বিপ্লব করা, সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব এবং স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা বলে তারা তাদের ভাববাদী আধিবিদ্যক বিশ্বদৃষ্টিকোনের পরিচয় প্রকাশ করেছে। যদিও নয়া সংশোধনবাদীদের সাথে এদের কিছুটা পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু তাহলো মূলতঃ তাত্ত্বিক দেউলিয়াত্বের পার্থক্য, মৌলিকতার নয়। তারা একই পালের ষাড় যদিও রঙের দিক দিয়ে তাদের মাঝে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। নয়া সংশোধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্র হলো অতিশয় চতুর, মুখোশ আঁটতে দক্ষ এবং তাদের সংশোধনবাদ হচ্ছে অতিশয় সুসংবদ্ধ। পক্ষান্তরে দেবেন-মতিনদের ভাওতা হচ্ছে প্রকাশ্য ও স্থূল এবং তাত্ত্বিক বুদ্ধুতার প্রকাশ।

 

জয় সর্বহারা

এই শ্লোগান উত্থাপিত হয়েছে… দেবেন-মতিনদের…দ্বারা। এই শ্লোগান পুনর্বার প্রমাণ করছে তাদের ট্রটস্কি-চেবাদী চরিত্র।

সর্বহারার ও বুর্জোয়াদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব চূড়ান্তভাবে মীমাংসিত হবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সমাপ্ত করে। কমিউনিজম বাস্তবায়নের মাধ্যমে।

সর্বহারারা বর্তমান মুহুর্তে শ্রেণীগতভাবে সংখ্যালঘু; এমনকি সমাজতান্ত্রিক সমাজেরও একটি পর্যায় পর্যন্ত সংখ্যালঘু থাকবে। এ অবস্থায় তাকে চূড়ান্ত মুক্তি অর্জন করতে হবে ধাপে ধাপে সমগ্র জনতাকে মুক্ত করার মাধ্যমে; অন্য কথায় সর্বহারারা নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারবে না মানবগোষ্ঠীকে মুক্ত করা ব্যতীত

বর্তমান পূর্ববাংলার সমাজ, যেখানে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক স্তর অতিক্রম করেনি, সেখানে জয় সর্বহারা শ্লোগান বলে তারা তাদের পুরনো ট্রটস্কি-চেবাদী তত্ত্ব অর্থাৎ, এক ধাক্কায় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সমাপ্ত করার কথা প্রকাশ করছে।

ইহা পুরোপুরি ও সম্পূর্ণরূপে ট্রটস্কি-চেবাদ। আমরা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাপ্ত করেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুরু করতে পারি, একতলা (জনগণতন্ত্র) অতিক্রম করেই দোতলায় (সমাজতন্ত্র) উঠতে পারি। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের শ্লোগান “জয় সর্বহারা” উত্থাপন করে তারা তাদের ট্রটস্কি-চেবাদী চরিত্র প্রকাশ করেছে।

এই শ্লোগান যদিও আকৃতিগতভাবে বাম কিন্তু সারবস্তুগতভাবে ডান। কারণ ইহা বর্তমান বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর্যায়ে বুর্জোয়া ও তাদের ব্যক্তি মালিকানার উৎখাতের কথা বলে ব্যাপক জনতার (যারা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে জমির মালিক হতে চায় এবং বৈদেশিক পুঁজি উৎখাত করে জাতীয় পুঁজির বিকাশ ঘটাতে চায়) বিরোধীতা করা হয়, জনতা থেকে বিপ্লবীদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং বিপ্লবের পরাজয় ডেকে আনে; জনতাকে বড় বুর্জোয়াদের পিছনে ঠেলে দেয়।

 

জয় বিপ্লবী

এই শ্লোগান ষড়যন্ত্রকারী কাজী-রনো বিশ্বাসঘাতক চক্র কর্তৃক উত্থাপিত। এরা এ শ্লোগানের মাধ্যমে কোন সামাজিক দ্বন্দ্ব বা দ্বন্দ্বের স্তরের সমাধান করতে চায় তা বোঝা মুশকিল। এই শ্লোগান একটি বিভেদপন্থীমুলক শ্লোগান যা বিপ্লবীদেরকে ব্যাপক জনতার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তাদের ধ্বংস নিয়ে আসে।

 

জয় বাংলা না জয় পূর্ববাংলা

বর্তমান সামাজিক অবস্থায় জয় বাংলা শ্লোগান ব্যাপক জনসাধারণের কন্ঠে শোনা যায়। এটা একটা জনপ্রিয় শ্লোগান।

জয় বাংলা শ্লোগান দ্বারা ৬-দফা আওয়ামী লীগ বৃহত্তর বাংলা অর্থাৎ, পূর্ববাংলার সাথে পশ্চিম বাংলাকে সংযুক্ত করে বৃহত্তর বাংলা জয়ের সুখ কল্পনা প্রকাশ করছে। এই কল্পনা কখনও বাস্তবায়িত হবে না। ইহা একটি অলীক কল্পনা মাত্র।

পূর্ববাংলার সাধারণ মানুষ এই শ্লোগান প্রদানের সময় পূর্ববাংলার নিপীড়িত লাঞ্চিত জনগণের শোষকদের উপর বিজয় কামনা করে, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখে।

আমরা পূর্ববাংলার জনসাধারণের সংগ্রামকে সমর্থন করে তাকে নেতৃত্ব প্রদান করি ও পরিচালনা করি শেষ পর্যন্ত। কিন্তু বৃহত্তর বাংলার স্বপ্নকে আমরা দৃঢ়ভাবে বিরোধীতা করি, আরো বিরোধীতা করি স্বাধীন পূর্ববাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের অনুপ্রবেশ।

আমরা পক্ষান্তরে ব্যাপক জনতার সাথে সমর্থন করি পূর্ববাংলার জাতীয় বিজয়, তার স্বাধীনতা এবং বিশ্বের জাতিসমূহের মাঝে সগৌরবে মাথা তুলে দাড়াবার অধিকার। আমরা সাধারণ মানুষের জাতীয়তাবোধ স্বদেশপ্রেম সমর্থন করি, কিন্তু তাকে বুর্জোয়াদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহারের বিরোধীতা করি।

কাজেই আমরা উত্থাপন করতে পারি “জয় পূর্ববাংলা” শ্লোগান। এটা পূর্ববাংলার বর্তমান সামাজিক বিকাশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটা বৃহত্তর বাংলার স্বপ্ন তথা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের অনুপ্রবেশকে স্পষ্টভাবে বিরোধীতা করে এবং পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয়তাবোধ, দেশপ্রেম এবং বিজয়কে প্রকাশ করে। এ কারণে এ শ্লোগান যে কোন প্রকার দ্বিধার অবসান করে। এটা পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তির প্রশ্নের সমাধান, জাতীয় দ্বন্দ্বের সমাধান। আমাদের রাজনীতির সাথে ইহা সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ কারণে এটা সঠিক।

 

স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ববাংলার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন!

এই শ্লোগান পূর্ববাংলার সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের বর্তমান পর্যায়ের সাথে সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বর্তমান পর্যায়ের প্রোগ্রাম। এ কারণে এটা সঠিক।

বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দুটো দিকের মাঝে পুর্ববাংলার বর্তমান সামাজিক বিকাশের পর্যায়ে প্রধান দিক হলো জাতীয় বিপ্লব; অর্থাৎ, পূর্ববাংলাকে পাকিস্তান থেকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন ও মুক্ত করে পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করা, এবং গৌণদিক হলো সামন্তবাদকে উৎখাত করা; বর্তমান পর্যায়ে এ কারণে জাতীয় মুক্তি বিরোধী সামন্তবাদীদের উৎখাত করা।

জাতীয় বিপ্লবের প্রশ্ন প্রধান থাকায় পূর্ববাংলার বুর্জোয়াসহ সমগ্র জাতি পুর্ববাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করবে এবং এতে অংশ গ্রহণ করবে। এ কারণে তাদের অংশগ্রহণ সহজতর করার জন্য পূর্ববাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের শ্লোগান উত্থাপন করা হয়েছে।

এ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে পূর্ববাংলাকে পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া (মার্কিন ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদ এবং সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ) এবং বাঙালী বুর্জোয়া ও সামন্তবাদী শাসকগোষ্ঠীর শোষণের অবসান করে।

এই প্রজাতন্ত্র বাস্তবায়িত করবে পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের মহান কর্মসূচী, অপসারিত করবে পূর্ববাংলার বুর্জোয়া বিকাশের বাধা, সমাপ্ত করবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সোপান বেয়ে নিশ্চিতভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির সৃষ্টি করবে।

কাজেই পূর্ববাংলার বর্তমান সামাজিক বিকাশের পর্যায়ে এ শ্লোগান সঠিক। □

 

নোট

১। Mao, selected works, vol-I, p-274

২। মতিনদের লেখা “জাতীয় অর্থনীতির চরিত্র–ধনতান্ত্রিক” পুস্তক দ্রষ্টব্য। ■