সিরাজ সিকদার রচনাঃ মতাদর্শগত পুনর্গঠনের জন্য দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রয়োগ

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার

 


পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ ১৯৭০

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক ১৯৭২ সালে ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীউদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কেসংকলনপুস্তিকায় প্রকাশিত

পূবাসপা কর্তৃক ১৯৭৪ সালেমতাদর্শগত রচনাবলীতে প্রকাশিত

সিপিএমএলএম বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ১২ ডিসেম্বর ২০১২


পিডিএফ

।। একটি নিবন্ধের ভিত্তিতে ।।

আমাদের একটা মহান দায়িত্ব হলো কর্মীদের মাঝে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত কাজ করে তাদের মতাদর্শগত দিক এগিয়ে নেয়া। এটা করা যায় তাদেরকে মাওসেতুঙ চিন্তাধারায় সুসজ্জিত করে, সর্বদাই সর্বহারার মতাদর্শকে সুসংবদ্ধ ও বৃদ্ধি করে এবং সকল প্রকার অসর্বহারা মতাদর্শকে বর্জন করে। এভাবে মাওসেতুঙ চিন্তাধারা কর্মীদের মাঝে আরও দৃঢ়ভাবে শিকড় গাড়বে এবং পশ্চাদগামী কমরেডগণ অগ্রসর কমরেডে পরিণত হবেন, অগ্রসর কমরেডগণ আরও বেশী অগ্রসর হবেন। এই কাজ ভালভাবে করতে গেলে একজনের সর্বপ্রথমে বিপ্লবী সংগঠন এবং কর্তব্যের জ্ঞান থাকতে হবে, সর্বদাই পার্টির কথা মনে রাখতে হবে, পার্টিকে গড়ে তুলতে হবে এবং কর্মীদের আজীবন বিপ্লবীতে পরিণত করতে সচেষ্ট হতে হবে। এ ছাড়াও একজনকে সঠিক চিন্তাধারা ও কাজের পদ্ধতি অর্থাৎ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে আঁকড়ে ধরতে হবে।

আমরা অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছি যে, যখন আমরা আমাদের কাজে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ প্রয়োগ করি তখন আমরা ভাল ফল পাই। আর যখন আমরা অধিবিদ্যা এবং আত্মগত একতরফাবাদের শিকার হই তখন আমরা নিজেদেরকে একটি ঘোরপাকে ফেলি; আমরা যত কঠোরভাবেই কাজ করি না কেন কিছুতেই আশান্বিত ফল পাই না।

অনগ্রসর কর্মীদের সঠিক বিশ্লেষণ করুন

অনগ্রসর কর্মীদের প্রতি অন্ধকার মনোভাব পোষণ করলে চলবে না। সচেতনভাবেই হোক আর অচেতনভাবেই হোক তাদের প্রতি অমনোযোগ প্রদর্শন করলে, অতিশয় সমালোচনামুখর হলে তারা নিজেদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে এবং অন্যান্য কমরেডও তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসার বিষয়ে হতাশ হয়ে পড়বে। এক নিজেকে দুইয়ে বিভক্ত করে—এই তত্ত্বের ভিত্তিতে তাদের মূলগত বিশ্লেষণ করতে হবে। তাদের ত্রুটিকে বাড়িয়ে দেখলে এবং তাকে অতিমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ, শোধরানো যাবে না মনে করলে, গৌণ ত্রুটিকে প্রধান এবং ছোটখাট বিষয়কে আসল বিষয় মনে করলে তাদের শোধরানোর ব্যাপারে আমরা হতাশ হয়ে যাবো।

আমরা তার খারাপ ও ভাল দিক খুঁজে বের করবো এবং তাদের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করবো। এটা কর্মীদের কাছে স্পষ্ট করে তুলবে যে তার ভাল দিকগুলো বেশী, খারাপ দিকগুলো কম। এইরূপ বিশ্লেষণ দ্বারা তার প্রতি কর্মীদের জন্য ধারণার সৃষ্টি হবে এবং তারা অন্য মনোভাব গ্রহণ করবে।

আমরা বারবার তার ভাল দিকগুলোর উল্লেখ করে প্রশংসা করবো এবং তার ত্রুটিগুলো দূর করার জন্য একটি একটি করে শত্রু ধ্বংস করার পদ্ধতি অনুসরণ করে এক সময় একটির বিরুদ্ধে সম্পুর্ণ ধ্বংসের অভিযান পরিচালনা করবো। এভাবে উৎসাহ এবং সাহায্য পেয়ে অনগ্রসর কর্মীরা উদ্দীপিত ও উৎসাহিত হবে এবং অনেক উন্নতি করবে।

এ থেকে আমরা শিক্ষা লাভ করি যে, আমাদের কমরেডদের সম্পর্কে মুলগত বিশ্লেষণ করতে হবে। সকল কমরেডদের চিন্তাধারাকে দুটি ভাগ করা যায়, তাদের ইতিবাচক দিকও আছে এবং নেতিবাচক দিকও আছে, শক্তিশালী দিকও আছে, দুর্বলতার দিকও আছে। এ দিকগুলো কখনও সমান নয়। সাধারণতঃ ইতিবাচক দিকগুলো সর্বদা প্রধান ও আসল। অগ্রসর কমরেডদের তুলনায় পশ্চাদপদ কমরেডদের বেশী দুর্বল দিক রয়েছে এবং তাদের উন্নতি ধীর গতিতে হয়। কিন্তু এতে এটা বুঝা যায় না যে, তাদের নিষ্ক্রিয় দিক আসল বা প্রধান দিক।

পশ্চাদপদ কমরেডদের মূলগত বিশ্লেষণের পর তাদের প্রতি একটা শ্রেণী সমতাবোধ জাগবে এবং অগ্রসর হবার জন্য তাদের মধ্যে আত্মপ্রত্যয় জন্মাবে। এ প্রকার বিশ্লেষণ ছাড়া, বিষয়গুলো আত্মগত এবং একতরফাভাবে দেখলে একজন অবশ্যই তাদের ত্রুটিকে বিরাট করে দেখবে ও হতাশার শিকারে পরিণত হবে এবং সাহায্য করার স্পৃহা হারাবে।

পশ্চাদপদ কমরেডদের মুলগত বিশ্লেষণ করলে তারা নিজেদের সম্বন্ধে একটি সঠিক পরিমাপ করতে পারবেন। এ সকল কমরেড অনেক সময় হতাশ হয়ে নিজেদের সম্বন্ধে একতরফা মনোভাব গ্রহণ করেন এবং অগ্রসর হওয়ার বিশ্বাসের অভাবে ভোগেন। নেতৃত্ব এসব কমরেডদের প্রতি বিশ্বাস রাখলে তাদের নিজেদের প্রতি বিশ্বাস ফিরে আসবে, তারা বেশী উৎসাহ লাভ করবে এবং অতিমাত্রায় উন্নতি লাভ করবে। কিন্তু নেতৃত্ব যদি তাদের প্রতি আস্থা হারায় তাহলে তারা হতাশ হয়ে পড়বে এবং তাদের উন্নতি আরো ধীর গতিতে হবে।

অনগ্রসর কর্মীদের অগ্রসর হবার প্রাক্কালে তাদের মনোবলের যে উঠানামা হয় তা আমাদের বিবেচনা করতে হবে তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী ও কাজের পদ্ধতি নির্ণয় করার সময়।

মতাদর্শগত পুনর্গঠনের জন্য পশ্চাদপদ কমরেডদের

নিজেদের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সাহিত করা

সভাপতি মাওসেতুঙ বলেছেন যে, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মতে “বাহ্যিক কারণ হচ্ছে পরিবর্তনের শর্ত, আভ্যন্তরীণ কারণ হচ্ছে পরিবর্তনের ভিত্তি; আভ্যন্তরীণ কারণের মাধ্যমে বাহ্যিক কারণ সক্রিয় হয়” পশ্চাদপদ কমরেডদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাদের নিজেদের মনে যুদ্ধ করার এবং নিজেদের ইচ্ছায় পরিবর্তিত করার প্রেরণা দেয়া। এভাবে কেবলমাত্র নিজেদের উদ্যোগে এ প্রকার যুদ্ধ করে তারা তাদের মনের সর্বহারা মতাদর্শ দ্বারা অসর্বহারা মতাদর্শকে ধ্বংস করতে পারবে এবং তারা নিজেদেরকে পশ্চাদপদ স্তর থেকে অগ্রবর্তী স্তরে উন্নীত করতে পারবে। যদি তারা এ ধরনের যুদ্ধ নিজেদের বিরুদ্ধে না করে এবং কেবলমাত্র তাদের বিরুদ্ধে অন্য কর্তৃক পরিচালিত সংগ্রামের মোকাবেলা করে তাহলে শুধুমাত্র-যে যুদ্ধ বিফলে যাবে তাই নয় কমরেডদের মাঝে সম্পর্কের অবনতি হবে এবং সকল বিষয়টি এক হ-য-ব-র-ল অবস্থায় পরিণত হবে।

অন্যদিকে বাহ্যিক কারণ বস্তুর বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নেতৃত্ব এবং কমরেডদের প্রদত্ত সাহায্য একটি পশ্চাদপদ কমরেডের পরিবর্তনে বিরাট প্রভাব ফেলে। কোন অবস্থায়ই আমরা বাহ্যিক অবস্থাকে বাদ দিয়ে আভ্যন্তরীণ কারণকে অতিমাত্রায় জোর দেব না যাতে আমরা আমাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি অথবা পশ্চাদপদ কমরেডদের সাহায্যের জন্য আমাদের চেষ্টায় ঢিল দিতে পারি। কাজেই আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে বাহ্যিক কারণ সক্রিয় হতে পারে আভ্যন্তরীণ কারণের মাধ্যমে। এ সকল কমরেডদের সাহায্য করার সময় তাদের সমস্যাকে আমরা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করবো, খুঁজে বের করবো কোনটা তাদেরকে সবচেয়ে বেশী অসুবিধায় ফেলছে। তাদেরকে উৎসাহিত করবো বুর্জোয়া ভাবধারার বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম করতে এবং বুর্জোয়া ভাবধারা দূর করে সর্বহারা মতাদর্শ গ্রহণ করতে এবং তাদের রাজনৈতিক চেতনা উন্নত করতে।

পশ্চাদপদ কমরেডদের মতাদর্শগত সংগ্রামে সাহায্য করতে গিয়ে আমরা দৃঢ়ভাবে মুল সমস্যা আঁকড়ে ধরবো, যা হলো তাদের বিশ্বদৃষ্টিকোণ পরিবর্তন করা। এটা বুঝায় যে আমরা সর্বপ্রকার চেষ্টা করবো এ সকল কমরেডদের মাঝে অল্প অল্প করে মাওসেতুঙ চিন্তাধারা ঢোকাতে। আমরা অবশ্যই তাদের সাহায্য করবো মাওসেতুঙ চিন্তাধারা শেখাতে এবং জীবন্তভাবে প্রয়োগ করতে যাতে তারা তাদের প্রধান সমস্যার সমাধান করতে পারে। আমরা তাদের উৎসাহিত করবো যখন তারা মাওসেতুঙের বই পড়ে, তাদের প্রশংসা করবো যখন তারা যতটুকু শিখেছে তা প্রয়োগ করতে চেষ্টা করে। আমরা তাদের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করবো যাতে তারা তাদের শিক্ষাকে ভালভাবে প্রয়োগ করতে পারে। আমরা তাদের সর্বদাই উৎসাহিত করবো তত্ত্বকে অনুশীলনের সাথে সংযুক্ত করতে। বিশেষ করে বেশী জোর দেব প্রয়োগ করতে এবং সর্বদাই মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে তাদের অসর্বহারা চিন্তাকে সমালোচনা ও বর্জন করতে। এভাবে ধীরে ধীরে মাওসেতুঙ চিন্তাধারা তাদের মাঝে শিকড় গাড়বে এবং তাদের মাঝে প্রধান দিকে পরিণত হবে এবং তারা পশ্চাদপদ থেকে অগ্রবর্তী কমরেডে পরিণত হবে।

পশ্চাদপদ কমরেডদের তাদের মনের মধ্যে যুদ্ধ করতে সাহায্য করার সময় আমরা অবশ্যই তাদের প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্যসমূহ অনুধাবন করবো। কারো হয়ত বেশী সমস্যা রয়েছে, কারো বা কম। এভাবে কমরেডদের পার্থক্যকে বিশ্লেষণ করতে হবে এবং তাদের প্রত্যেকের বিষয়কে আলাদা করতে হবে। যদি আমরা সকলকে সম্পূর্ণ এক রকম মনে করি তাহলে কোন কাজ হবে না। যদি আমরা প্রতিটি বিষয় তার গুরুত্ব অনুযায়ী অনুধাবন না করি এবং “চাউল ও ভূট্রা একই পাত্রে সেদ্ধ” করি তার ফল হবে অর্থহীন। অর্থাৎ চাউল হবে বেশী সেদ্ধ, ভূট্রা হবে কম সেদ্ধ।

পশ্চাদপদ কমরেডদের সাহায্য করার সময় সাংগঠনিক এককের উপর নির্ভর করাও প্রয়োজন। জনগণকে জাগরিত এবং একককে লাল স্কুলে পরিণত করতে হবে। এভাবে একটা সুবিধাজনক অবস্থা হবে, যেখানে অনগ্রসর কমরেডরা অগ্রসর হবার সুযোগ পায়। অর্থাৎ কমিটিতে একটি সুন্দর অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে যেখানে সবাই অধ্যবসায়ের সাথে সভাপতি মাওয়ের রচনাবলী পাঠ করে এবং সবাই সকল কাজে রাজনীতিকে সামনে রাখে এবং সমস্যা সমাধানের নীতির প্রতি অটল থাকে। একজনের ত্রুটি ও সমস্যা সকলের চিন্তার বিষয় হবে এবং কমরেডদের সাহায্য করার জন্য সব দিকেই হাত প্রসারিত থাকবে। আমরা যদি এককের সদস্যদের উপর নির্ভর না করি এবং তাদের জাগরিত না করি তাহলে আমরা পশ্চাদপদ কমরেডদের পরিবর্তন করতে ভাল ফল পাবো না।

অনগ্রসর থেকে অগ্রসরে রূপান্তরিত হওয়া

একটি বারংবার সংগ্রামের প্রক্রিয়া

পশ্চাদপদ থেকে অগ্রবর্তী হওয়া একটি সাধারণ ব্যাপার নয়। এটা সর্বদাই একটি দীর্ঘস্থায়ী দুরূহ প্রক্রিয়া। সর্বহারার দৃষ্টিকোণ লাভ করতে হলে একজনকে অবশ্যই অসর্বহারা মতাদর্শ দূর করতে হবে। একটি কঠোর কর্মপদ্ধতি রপ্ত করতে হলে একজনকে অবশ্যই বিলাসিতা দূর করতে হবে এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ গড়ে তুলতে হলে একজনকে অবশ্যই আধিবিদ্যক দৃষ্টিকোণ ত্যাগ করতে হবে।

যদিও এ সকল পশ্চাদপদ কমরেডদের পুরোনো ধারণা ও অভ্যাস এদের চরিত্রের প্রধান দিক নয় তবুও তা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। তাদের কিছু কিছু অনেক আগের সৃষ্টি এবং তা তাদের মাঝে গভীরভাবে শিকড় গেড়েছে। পুরোনো ধারণা ও অভ্যাসকে পরিবর্তন করে নতুন ধারণা ও অভ্যাস রপ্ত করা একটি কষ্টকর বিষয়। মার্চ করার কথাই ধরা যাক; সামরিক বাহিনীতে এটা প্রাত্যহিক ব্যাপার। কিন্তু যেসব কমরেড সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পূর্বে সামান্য দূরত্বও বাসে যেতেন তাদের জন্য তিরিশ মাইল হাঁটা বাস্তবিকই কষ্টকর। এই হঠাৎ পরিবর্তন মৃত্যুর মতো তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাবে একটি বড় রকমের অন্তর্দ্বন্দ্বে। এটা আশ্চর্য নয়। কিছু কমরেড অভিযোগ করবে এবং পশ্চাতে পড়ে রবে। কেবলমাত্র বাধাবিঘ্নের সাথে বারংবার সংগ্রাম করে এবং অনুশীলনে অভিজ্ঞ হয়ে তারা কষ্ট বা পরিশ্রমকে ভয় না করার মনেবৃত্তি লাভ করতে পারে। পরিবর্তনের এই দীর্ঘস্থায়ীত্ব ও দূরূহতা সম্বন্ধে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। অকারণে দ্রুত বিজয় অর্জনের ইচ্ছা করলে চলবে না। এটা আশা করলে হবে না যে অনগ্রসর কমরেডরা সব ত্রুটি দূর করে এক রাতেই প্রথম শ্রেণীর কমরেডে পরিণত হবে। একজন পাচক যে অতি সত্বর রান্নার জন্য চুলোয় কেবল আগুন দিয়েই যাচ্ছে কিন্তু লক্ষ্য করছে না পাতিলের ভাত এ আগুন সহ্য করতে পারবে কিনা, আমরা তেমনি তাড়াহুড়ো করে কিছুই অর্জন করতে পারবো না এবং পশ্চাদপদ কমরেডগণ আরো হতাশ হয়ে যাবে। অনগ্রসর থেকে অগ্রসরে পরিবর্তন পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়া। দ্রুত উন্নতি, দ্রুত অতিক্রমণ সম্ভব হয় পরিবর্তনের একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত পৌঁছলে।

প্রথম দিকে পশ্চাদপদ কমরেডগণ অগ্রসর কমরেডদের তুলনায় পরিষ্কারভাবে দেখতে পারে না অথবা সঠিকভাবে সমস্যার মোকাবেলা করতে পারে না। কোন কোন সময় তাদের চিন্তা ও কাজের অসংলগ্নতা প্রকাশ পায়। কোন কোন কমরেড কাজ করতে যেয়ে অন্যকে কেবল অনুসরণ করেন। এর কারণ তাদের পূর্ণ রাজনৈতিক সজাগতার অভাব রয়েছে। কোন কোন কমরেড তাদের বুঝবার ক্ষমতার উন্নতি করেছেন, কিন্তু তাদের কাজ তাদের চিন্তার চেয়ে পশ্চাদপদ। যদিও পশ্চাদপদ কমরেডদের এ পরিবর্তন এমন একটা বড় কিছু নয় কিন্তু তবুও এটা তাদের অগ্রসর হওয়ার লক্ষণ। অগ্রগতির এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলোকে তাদের পরিবর্তনের সূচনা বলে ধরে নিয়ে আমরা অবশ্যই কষ্টকর ও পদ্ধতিগত কাজ করবো এবং তাদের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করার জন্য উৎসাহিত করবো। যখন তারা অপর্যাপ্ত উপলব্ধি দ্বারা একটা ভাল কাজ করে তখন আমরা তাদেরকে অবহেলা করবো না। আমরা তাদের রাজনৈতিক মানকে উন্নত করার চেষ্টা করবো। ওই সকল কমরেড যাদের রাজনৈতিক মান উন্নত হয়েছে কিন্তু যাদের কাজ এখনও তাদের উপলব্ধির চেযে পশ্চাদপদ, তাদেরকে আমরা এই বলে দোষারোপ করবো না যে তাদের কথায় ও কাজে মিল নেই। বরঞ্চ তাদেরকে উৎসাহিত করবো সঠিক চিন্তাধারা দ্বারা তাদের কউকে পরিচালিত করার জন্য। যদি আমরা এর উল্টো করি তবে আমরা সঠিকভাবে সময়মত তাদেরকে অগ্রগতির পথে পরিচালিত করতে পারবো না। সাধারণভাবে বলতে গেলে পশ্চাদপদ কমরেডগণ তাদের অগ্রগতির পথে বিপর্যয় অনুভব করবে। তাদের চিন্তার স্তরের উঠানামা হবে। এটা সাধারণ যে কয়েকটি বিপর্যয় ব্যতীত পুরোনো ধারণা ও অভ্যাস সম্পূর্ণরূপে মীমাংসা করা যায় না এবং সভাপতি মাওসেতুঙের চিন্তাধারা গভীরভাবে তাদের মনে শিকড় গাড়তে পারবে না। কেবলমাত্র তাদের এই বিপর্যয় স্বীকার করে এবং তাদেরকে বুঝে, তাদের পেছনের কারণ খুঁজে বের করে এবং মানুষের মতাদর্শগত পরিবর্তনের নিয়মাবলী আবিষ্কার করে আমরা বিপর্যয়সমূহ খুবই কমাতে পারি।

মতাদর্শগত পুনর্গঠন খুবই জটিল। আমাদের চিন্তায় ও কাজে আমরা অবশ্যই তাকে খুবই সহজভাবে গ্রহণ করবো না। আমরা দৃঢ়ভাবে পশ্চাদপদ কমরেডদের সাহায্য করার কাজ আঁকড়ে ধরবো এবং লেগে থাকবো শেষ পর্যন্ত। আমরা অবশ্যই একটা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ পরিচালনা করবো এবং চিন্তা করবো না যে সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে এক রাতে। শুরুতে তাদের উৎসাহিত করবো পুরোনো ধারণার বিরুদ্ধে বিক্রমের সাথে লড়াই করতে; যখন তারা বিজয় অর্জন করবে তখন আমরা অবশ্যই তাদেরকে আহ্বান জানাবো সংগ্রাম চালিয়ে যেতে। যখন তাদের মধ্যে প্রগতিশীল ধারণা প্রধান দিকে পরিণত হয়েছে তখন তাদেরকে আহ্বান জানাবো ঢিলে না দিতে। আমরা তাদেরকে অবশ্যই উৎসাহিত করবো এবং শিক্ষা দেব যাতে তারা নেতিবাচক দিক প্রধান হলে হতাশ না হয়ে যায়। আমরা সকল অবস্থায় পশ্চাদপদ কমরেডদের সাথে “এক নিজেকে দু’য়ে বিভক্ত করে”—এ তত্ত্ব অনুযায়ী ব্যবহার করবো। আমরা তাদেরকে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত মনে করবো না যদি তারা কিছুটা উন্নতি করেন, আমরা বিশ্বাসও হারাবো না যে তাদের ত্রুটি রয়েছে। আমরা প্রতিনিয়ত তাদেরকে উৎসাহিত করবো তাদের মতাদর্শকে বিপ্লবী করতে।

অগ্রসর কমরেডদের প্রতিএক নিজেকে দুয়ে বিভক্ত করে

পদ্ধতি প্রয়োগ করে তাদেরকে আরো অগ্রসর করা

অগ্রসর ও অনগ্রসর হলো বিপরীতের একত্ব এবং আপেক্ষিক ও পরস্পর রূপান্তরযোগ্য। পশ্চাদপদ কমরেডগণ অগ্রসর হতে পারেন এবং অগ্রসররা আরো অগ্রসর হতে পারেন অথবা পশ্চাদপদ হয়ে যেতে পারেন। সে কারণে আমরা অগ্রসর কর্মীদের “এক নিজেকে দু’য়ে বিভক্ত করে” এ তত্ত্ব দ্বারা বিচার করবো যাতে তাদেরকে আমরা আরো অগ্রসর হতে সাহায্য করতে পারি এবং তাদের পশ্চাতে পড়ে যাওয়া ঠেকাতে পারি।

অগ্রসর কর্মীদের মুল্যায়ন করার সময় আমরা এই ধরণের একতরফাবাদী ভুল করবো নাঃ প্রথম হলো তাদেরকে পূর্ণ সঠিক ভেবে দেখলে চলবে না, তাদের দুর্বলতাকেও দেখতে হবে। দ্বিতীয়টি হলো আমরা এক-আধটি ত্রুটিপূর্ণ কমরেডদের পশ্চাদপদ বলে চিন্তা করবো না।

কমরেডদের মূল্যায়নে এ প্রকারে ত্রুটি হবে না যদি আমরা “এক নিজেকে দু’য়ে বিভক্ত করে”—এ পদ্ধতি প্রয়োগ করি। অগ্রসর কর্মীদের বেশী শক্তিশালী দিক আছে এবং তাদের শ্রেণী চেতনা অনেক উঁচু। কিন্তু তাদেরও অসর্বহারা চিন্তাধারা এবং ত্রুটি রয়েছে। যেটা আরো গুরুত্বপূর্ণ তা হলো তারা সহজেই আত্মতুষ্টি লাভ করে এবং মতাদর্শগত পুনর্গঠনের কাজে ঢিল দিতে পারে। আমাদের অবশ্যই তাদের শক্তিশালী ও দুর্বল দিক, উভয়ই জানতে হবে এবং তাদের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব দেখাবো না এবং তাদের ত্রুটিকে এড়িয়ে যাবো না; আমরা তাদেরকে শিক্ষা দেব নিজের প্রতি “এক নিজেকে দু’য়ে বিভক্ত করে” —এ মনোভাব গ্রহণ করতে। আমরা তাদের শিক্ষা দেব যাতে তারা অবিচ্ছিন্নভাবে বিপ্লব করে যেতে পারে। আমরা তাদের দায়িত্ব গুরুত্ব সহকারে নেব এবং তাদের জন্য শক্ত মাপকাঠি প্রয়োগ করবো এবং তাদেরকে সাহায্য করবো তাদের দুর্বল দিকগুলো কাটিয়ে উঠতে। আমরা তাদেরকে বলবো সভাপতি মাওয়ের রচনাবলীর প্রতি আরো বেশী নজর দিতে, তা পাঠ করার জন্য অধিকতর সময় ব্যয় করতে, তা আরো গভীরভাবে বুঝতে এবং ভালভাবে প্রয়োগ করতে। তাদের সাহায্য করতে যেয়ে আমরা তাদের মূল বিষয়গুলো আঁকড়ে ধরবো। যদি আমরা ছোটখাট ব্যক্তিগত ত্রুটির জন্য তাদের দোষ ধরি, তারা মনোবল হারাবে এবং অতি সাবধানী হয়ে যাবে এবং প্রধান বিষয়ের প্রতি মনোনিবেশ করতে পারবে না।

বাস্তব অনুশীলনে আমাদের এ ধরনের একতরফাভাব থাকলে চলবে না অর্থাৎ অগ্রসর কমরেডদের সর্বদা সম্পূর্ণ সঠিক হিসেবে চাইলে চলবে না। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বো না যখন তাদের একটা-আধটা ত্রুটি দেখতে পাই। এই একতরফাভাব বিশেষভাবে প্রকাশ পেতে পারে যারা পুর্বে পশ্চাদপদ কমরেড ছিল তাদের প্রতি। এক-আধটি ত্রুটির জন্য তাদের সম্পূর্ণ রেকর্ড খারাপ লিখে দিলে চলবে না এবং তাদের উৎসাহ নিভিয়ে দিলে চলবে না।

এটা অবশ্যই সঠিক যে অগ্রসর কর্মীদের জন্য একটি শক্ত মানদণ্ড ঠিক করা, কিন্তু এই মানদণ্ড অর্জনসাপেক্ষ হতে হবে, যুক্তিযুক্ত হতে হবে এবং সীমার বাইরে নয়। আমরা তাদের ত্রুটির বিশ্লেষণ করবো। কিন্তু আমরা ছোটখাটো ত্রুটিকে গভীর নীতিগত ত্রুটি বলে ভুল করবো না; দুর্ঘটনাবশতঃ ত্রুটিকে গভীর শিকড়বিশিষ্ট ত্রুটি বলে মনে করবো না, বাস্তব অসুবিধাকে মতাদর্শগত সমস্যা বলে মনে করবো না। কেবলমাত্র যখন আমরা বিষয়গুলো এভাবে মীমাংসা করবো তখনই তাদের উৎসাহকে জাগানো যায় এবং তাদের দুর্বল দিকগুলো দূর করা যায়।

অগ্রসরদের আরো বেশী অগ্রসর হতে সাহায্য করতে যেয়ে আমরা শুধু তাদের দুর্বল দিকগুলোর প্রতি গভীর নজর দেব তাই না, তাদের মাঝের শক্তিশালী দিকগুলোর প্রতি নজর দেব। আমরা তাদের সাহায্য করবো এ সকল শক্তিশালী দিকগুলো বিকাশ লাভ করাতে এবং তা যাতে অধিক প্রাধান্য লাভ করে।

যখন তারা তাদের শক্তিশালী দিকের বিকাশ ঘটিয়েছে এবং সভাপতি মাওয়ের লাল পতাকাকে আরো ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে তখন তাদের নেতিবাচক দিকগুলো দূর করার জন্য তারা তাদের উদ্যোগ এবং শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে।

সর্বহারা মতাদর্শকে আয়না হিসেবে ব্যবহার করে আমরা অসর্বহারার মতাদর্শকে অবশ্যই চিনতে সক্ষম হবো এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করে আমরা ভাববাদী চিন্তাধারাকে পরিষ্কারভাবে চিনতে সক্ষম হবো। অগ্রসর কর্মীদের প্রগতিশীল দিকগুলোকে যদি আমরা অবহেলা করি এবং আমাদের মনোযোগ কেবল তাদের খারাপ দিকের দিকে দেই তবে তারা বিভ্রান্ত হবে এবং দিশা হারিয়ে ফেলবে—দুর্বল ও অতি সাবধানী হয়ে যাবে। তারা তাদের সবল দিকগুলোর বিকাশে বাধাগ্রস্ত হবে, নতুন কিছূ সৃষ্টি করতে পারবে না।

অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিখি যে, যখন আমরা অগ্রসর কমরেডদের ত্রুটি দূর করতে সাহায্য করি, তখন আমরা একই সঙ্গে তাদের ভালো দিকের বিকাশ ঘটাবো। আমরা তাদের শিক্ষা দেব, তাদের ভাল দিকগুলোর আরো বিকাশ ঘটাতে, চেষ্টা করবো তাদের বিপ্লবী সৃজনশীলতাকে পূর্ণভাবে বের করতে এবং তারা যাতে আরো অগ্রসর হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা ত্রুটিমুক্ত হয়। এভাবে একটি শক্তিশালী আন্দোলনের সুচনা হয়। অগ্রগামীদের অনুকরণের জন্য, তাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য, তাদের সমকক্ষতা অর্জন করার জন্য।

অনগ্রসর কমরেডদের অগ্রসর কমরেডে পরিণত করতে এবং অগ্রসরদের আরো অগ্রসর করতে গেলে আমরা বুঝতে পারবো যে, এটা অধ্যয়ন, অনুশীলন এবং বুঝবার স্তর অতিক্রম করার অবিরাম প্রক্রিয়া। সভাপতি মাওয়ের রচনাবলী অধ্যয়ন এবং প্রয়োগ করে নিজেদের মতাদর্শকে আরো বিপ্লবী করতে আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে এবং সর্বান্তকরণে প্রচেষ্টা চালাতে হবে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টিকোণ অধিকতর ভালভাবে লাভ করতে এবং অধিবিদ্যক বিশ্বদৃষ্টিকোণ দূর করে কর্মীদের মতাদর্শগতভাবে উন্নত করতে। ■