সিরাজ সিকদার রচনাঃ অভিজ্ঞতার সারসংকলন সম্বন্ধে

 

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার

 


পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ ১৯৭০

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক ১৯৭২ সালে ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীউদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কেসংকলনপুস্তিকায় প্রকাশিত

পূবাসপা কর্তৃক ১৯৭৪ সালেমতাদর্শগত রচনাবলীতে প্রকাশিত

সিপিএমএলএম বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ১২ ডিসেম্বর ২০১২


পিডিএফ

 

।। পিকিং রিভিউ-এর একটি প্রবন্ধের ভিত্তিতে রচিত ।।

 

ভুল এবং বিপর্যয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমরা অধিকতর জ্ঞানী হয়েছি আমাদের কার্যাবলী আরো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করছি কোন রাজনৈতিক পার্টির পক্ষে ভুল এড়ানো সহজ নয়, তবে আমাদের যথাসম্ভব কম ভুল করা উচিত একবার ভুল হলে তা শোধরানো উচিত, এবং তা যত শীঘ্র সার্বিকভাবে হয় ততই ভাল

— মাও সেতুঙ

নেতৃস্থানীয় কর্মীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো মাও সেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে ন্যায়পরায়ণতার সাথে অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা এবং অধিকতরভাবে নিজেদের বিশ্বদৃষ্টিকোণকে পরিবর্তন করা যাতে তারা সক্ষম হন বিপ্লবের আরো ভালোভাবে নেতৃত্ব দিতে।

সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, “একজন নেতার দায়িত্ব সংগ্রামের পথ এবং লক্ষ্যসমূহ উল্লেখ করাই নয়, সে অবশ্যই বিশেষ অভিজ্ঞতার সারসংকলন করবে এবং দ্রুত জনগণের মাঝে তা ছড়িয়ে দেবে যাতে যা সঠিক তা অনুসরণ করা হয় এবং যা ভুল তার পুনরাবৃত্তি না হয়” এর মাঝে দুটো দিক রয়েছেঃ পুংখানুপুংখভাবে একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ক্ষণের সর্বহারা বিপ্লবের মুল অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা এবং বর্তমান সংগ্রামের বিশেষ অভিজ্ঞতার সময়মত সারসংকলন করা।

প্রতিটি সংগ্রামে ইতিবাচক ও নেতিবাচক অভিজ্ঞতা থাকবে, উভয়ই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ এবং তা সর্বদাই স্মরণ রাখা প্রয়োজন।

সভাপতি মাওসেতুঙ সম্প্রতি আমাদের শিখিয়েছেন, “ন্যায়পরায়ণতার সাথে অভিজ্ঞতার সারসংকলন প্রয়োজন যখন কেউ একটি সাংগঠনিক এককে অবস্থা অবগত হবার জন্য যায়, সে অবশ্যই গতির সামগ্রিক প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত হবেএর পত্তি, এর বিকাশ এবং বর্তমান অবস্থা, জনগণের মাঝে কি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে, এবং নেতৃত্বের মাঝে কি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে, কি কি দ্বন্দ্ব সংগ্রামের উদ্ভব হয়েছে এবং সকল দ্বন্দ্বের কি কি পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং জনগণ তাদের জ্ঞানের কি উন্নতি করেছে, যাতে করে এর নিয়মবিধি বের করা যায়

সকল স্তরের নেতৃত্বস্থানীয় কর্মীরা অবশ্যই সভাপতি মাও-এর নির্দেশের প্রতি নজর দেবেন এবং একে ন্যায়পরায়ণতার সাথে পালন করবেন।

সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দেন, “আমরা অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ হবো” এটা বুঝাবার জন্য আমরা অবশ্যই নীচের দিকে দৃষ্টিপাত করবো এবং জনগণের ছাত্র হবো। বিজয়ের সময় নেতৃস্থানীয় কর্মীরা বিনয়ী ও নম্র হবেন এবং অহংকার ও রুক্ষতার বিরুদ্ধে নজর রাখবেন। তারা অবশ্যই শ্রমিক-কৃষক ও জনতা কর্তৃক উত্থাপিত মতামত মনোযোগের সাথে শুনবেন ও সর্বহারার বিপ্লবী উৎসাহ এবং জনগণ থেকে বিনয়ের সাথে শিক্ষার সুন্দর পদ্ধতিকে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগাবেন।

সভাপতি মাও আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, আমরা গতির ‘সামগ্রিক প্রক্রিয়ার’ সাথে অবশ্যই পরিচিত হবো। এটা সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। কেবলমাত্র গতির সামগ্রিক প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত হয়েই ইহার প্রকৃত অবস্থা সার্বিকভাবে বুঝতে পারি। কেবলমাত্র এভাবেই আমরা বুর্জোয়া ও তার দালাল বিরোধী সর্বহারার সংগ্রামের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া বুঝতে পারি, কেবলমাত্র এভাবেই আমরা বুঝতে পারি বিভিন্ন অবস্থায় সর্বহারার শত্রুরা কি কি কৌশল অবলম্বন করেছে এবং কিভাবে শত্রুর ষড়যন্ত্রকে আমরা উন্মোচিত করতে পারি; এ প্রক্রিয়ায় শত্রু ও আমাদের এবং বিভিন্ন শ্রেণী ও রাজনৈতিক শ্রেণীসমূহের কি কি পরিবর্তন এসেছে; নেতৃত্ব ও জনগণের মাঝে কি কি পরিবর্তন এসেছে এবং কি কি বিপর্যয় ঘটেছে; কেবলমাত্র এভাবেই আমরা জনগণের মাঝে দ্বন্দ্বের সঠিক বিশ্লেষণ করতে পারি এবং সংগ্রামের বর্তমান ও ভবিষ্যত পর্যায়ে কি কি সমস্যার সমাধান করতে হবে তা বের করতে পারি এবং তা সমাধান করার উপায় নির্ণয় করতে পারি। সভাপতি মাও আমাদের শিখিয়েছেন, “আমরা দেশের অভ্যন্তরের বাইরের প্রদেশের, থানা বা জেলার বাস্তব অবস্থা থেকে অগ্রসর হবো এবং এগুলো থেকে আমাদের কাজের উপায় হিসেবে নিয়মবিধি রচনা করবো যা এর ভিতরে রয়েছে, কাল্পনিক নয়; র্থাৎ আমাদের চতুর্দিকে সংঘটিত ঘটনার আভ্যন্তরীণ যোগসূত্র বের করবো

সভাপতি মাও ইতিহাসের প্রক্রিয়াকে বুঝবার নির্দেশ দিয়েছেন; মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েট সংশোধনবাদ এবং দুনিয়ার সকল প্রতিক্রিয়াশীল চক্রকে বোঝা অতিশয় প্রয়োজন। “কুওমিনটাংএর ব্যাপারটা কি? এর অতীতের দিকে তাকাও, তাহলে এর বর্তমান বলতে পারবে, এর অতীত বর্তমানের দিকে তাকাও তাহলে এর ভবিষ্যত বলতে পারবে

শ্রেণী সংগ্রাম একটি বস্তুগত বাস্তবতা। সঠিক ধারণা সর্বদাই ভুল ধারণা থেকে পৃথক থাকবে এবং ভুল ধারণার সাথে সংগ্রামের মাঝ দিয়ে বিকাশ লাভ করবে। সভাপতি মাওয়ের সর্বহারা লাইনের প্রতি আনুগত্যের সাথে এর বিরোধী লাইনের সংগ্রাম, সর্বহারার বিশ্বদৃষ্টিকোণের সাথে বুর্জোয়া দৃষ্টিকোণের সংঘাত এবং সঠিক ধারণার সাথে ভুল ধারণার সংঘাত-এ দ্বন্দ্বগুলো সর্বদাই রয়েছে। গতির প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ এবং সময়মত অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা প্রয়োজন যাতে বিভিন্ন স্তরের অগ্রসর ব্যক্তিদের মাঝে এবং জনগণের মাঝে যে সকল মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব রয়েছে তার মীমাংসা হয় এবং চিন্তার ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়, অর্থাৎ আমরা অবশ্যই মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে ব্যবহার করবো আমরা যে কাজ করেছি তা পরীক্ষা করার জন্য; বিকাশের সময় যে সকল দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছে তার সার্বিক বিশ্লেষণ করবো, সঠিক ও ভুলের মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় করবো, ন্যায়পরায়ণতার সাথে সমালোচনা-আত্মসমালোচনা করবো, বিশেষ করে আত্মসমালোচনা করবো এবং সত্যিকারভাবে মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাথে যা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা আঁকড়ে ধরবো এবং মাওসেুতঙ চিন্তাধারার যা পরিপন্থী তা ধিকৃত ও বর্জন করবো। অভিজ্ঞতার সারসংকলন দ্বারা আমাদের ও শত্রুর মাঝের দ্বন্দ্ব, জনগণের মাঝের দ্বন্দ্ব অধিকতর ভালোভাবে বুঝতে পারবো, এ দু’ধরণের দ্বন্দ্বের মাঝে পরিষ্কার পার্থক্যরেখা টানতে পারবো, মোটামুটি বাস্তব অবস্থার সাথে খাপ খায় এরূপ উপয্ক্তু বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবো।

বাস্তব অবস্থা হলো আমাদের প্রত্যেকের কাজের সঠিকতা ও ভুলভ্রান্তি, অবদান (achievement) এবং সীমাবদ্ধতা (shortcomings)। আমরা সঠিক ধারণাকে এগিয়ে নেবো এবং ভুলকে অতিক্রম করবো। এটা আমাদের ঐক্যকে সুদৃঢ় করতে সহায়তা করবে-যে ঐক্যের ভিত্তি হলো মাও সেতুঙ চিন্তাধারা। অহঙ্কার ও আত্মতুষ্টি করার খারাপ অভ্যাস, নিজের সদগুণের গর্ব করা, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া, নিজের মত থেকে স্বতন্ত্র মতকে উড়িয়ে দেওয়া, মুখে এক কথা বলা, কাজে অন্য করা ও সবকিছূর ঊর্ধ্বে নিজের স্বার্থকে স্থান দেওয়ার খারাপ অভ্যাস, সব কিছুতেই একগুঁয়ে মনোবৃত্তি নিয়ে চলা, এগুলো হলো বুর্জোয়া বিশ্বদৃষ্টিকোণের প্রকাশ ও সঠিক অভিজ্ঞতার সারসংকলনের পথে বিরাট বাধা এবং এ কারণে এগুলোকে সমালোচনা ও বর্জন করতে হবে।

সভাপতি মাও আমাদের শিখিয়েছেন, “আমরা অবশ্যই একটি স্থানের জনগণের অগ্রসর অভিজ্ঞতাকে সাবধানতার সাথে খুঁজে নেবো, এর সারসংকলন করবো এবং তাকে জনপ্রিয় করবো সকল স্থানেই মোটমুটি অগ্রসর সাংগঠনিক একক রয়েছে আমরা অবশ্যই গভীরভাবে, ভাসাভাসা নয়, অনুসন্ধান অধ্যয়ন করবো, নিজ হাতে তথ্য সংগ্রহ করবো, ন্যায়পরায়ণতার সাথে বারবার অনুসন্ধান করবো, তথ্য সংগ্রহ করবো এবং সভাপতি মাওএর নির্দেশ পালনের উদাহারণ স্থাপন করবো বিশেষ অগ্রসর অভিজ্ঞতা সার্বজনীন গুরুত্বপূর্ণ এবং বুঝবার পক্ষে খুবই সহায়ক

সভাপতি মাও বলেছেন, “যে কোন সমাজ যেখানে শ্রেণী আছে সেখানে শ্রেণী সংগ্রাম শেষ হবে না শ্রেণীহীন সমাজে নতুন পুরাতনের মাঝের দ্বন্দ্ব এবং সত্য মিথ্যার মাঝের দ্বন্দ্ব শেষ হবে না

পাদন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সংগ্রামে মানবজাতি এবং প্রকৃতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচেছ, তারা কখনো একই স্তরে নিশ্চল থাকে না অতএব মানবজাতিকে সর্বদাই অভিজ্ঞতার সারসংকলন করতে হয় এবং আবিষ্কার, উদ্ভাবন, সৃষ্টি অগ্রগতি সাধন করতে হয় নিশ্চলতা, হতাশা, নিষ্ক্রিয়তা এবং অহংকার সবই ভুল”—সভাপতি মাও-এর এই দূরদর্শী বৈজ্ঞানিক থিসিস যা মানব সমাজের ও প্রকৃতির ইতিহাসের সাধারণ গতিধারার নির্দেশ করেছে, তা বিপ্লবী অনুশীলন পরিচালনার জন্য বিপ্লবী অভিজ্ঞতার সারসংকলনের গুরুত্ব স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছে। ■