সিরাজ সিকদার রচনাঃ বিভেদপন্থীবাদ

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার


পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন কর্তৃক প্রনীত ও  প্রকাশিত হয় ১৯৬৮৭০ সময়কালে

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক  ”ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীউদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কে পুস্তিকায়  এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে

পূবাসপা কর্তৃক নির্বাচিত মতাদর্শগত রচনাবলীতে এর প্রকাশ কাল ১৯৭৪

সিপিএমএলএম বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com)-এর অনলাইন প্রকাশনা ১২ ডিসেম্বর ২০১২


 

পিডিএফ

।।সভাপতি মাও সেতুঙ-এর “পার্টির কর্মপদ্ধতির শুদ্ধিকরণ করো” রচনার ভিত্তিতে।।

 

শুধুমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির ঐক্যের মাধ্যমেই সমগ্র শ্রেণী সমগ্র জাতির ঐক্য অর্জন করা যায় যাকিছু ঐক্যের ক্ষতি করে সে সব কিছুকে অবশ্যই দূর করতে হবে— মাও সেতুঙ

 

পার্টির আভ্যন্তরীণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং বাইরের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভেদপন্থীবাদ প্রকাশ পায়। পার্টির আভ্যন্তরীণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভেদপন্থীবাদ কমরেডদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং পার্টি-অভ্যন্তরস্ত ঐক্য এবং সংহতির ক্ষতি সাধন করে, অন্যদিকে বাইরের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভেদপন্থীবাদ পার্টি-বহির্ভূত জনগণ থেকে পার্টিকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং সমগ্র জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার পার্টির কর্তব্যের ক্ষতিসাধন করে। এই খারাপ বস্তুর দুটো দিককেই সমূলে উrপাটিত করে পার্টি কমরেডদের এবং দেশের সকল জনগণের ঐক্যের মহান লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতে পার্টি বাধাহীনভাবে অগ্রসর হতে পারে।

পার্টি অভ্যন্তরস্ত বিভেদপন্থীবাদ নিম্নভাবে প্রকাশ পায়ঃ

প্রথমঃ স্বতন্ত্রতার দাবী

কিছু কিছু কমরেড কেবল অংশের স্বার্থকে দেখেন কিন্তু সমগ্রের স্বার্থকে নয়; তারা সর্বদাই অপ্রয়োজনীয়ভাবে জোর দেন কাজের ঐ অংশের প্রতি, যা তাদেরকে করতে দেওয়া হয়েছে এবং সর্বদাই চান সমগ্রের স্বার্থকে নিজের অংশের অধীন করতে। তারা পার্টির গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার পদ্ধতি বোঝেন না; তারা উপলব্ধি করেন না যে, কমিউনিস্ট পার্টির শুধু যে গণতন্ত্রই প্রয়োজন তা নয়, কেন্দ্রীকতা প্রয়োজন আরো অধিক; তারা ভুলে যান গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার পদ্ধতি যেখানে সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর অধীন, নিম্নস্তর উচ্চস্তরের অধীন, অংশ সমগ্রের অধীন এবং সমগ্র সদস্যগণ “বিপ্লবী পরিষদ” (কেন্দ্রীয় কমিটি)-এর অধীন। চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতে চেংকাওতো কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে এ ধরণের স্বতন্ত্রতা দাবী করেছিল যার ফলে সে পার্টির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতায় নিজেকে ঠেলে দেয় এবং কুয়োমিনটাং-এর  এজেন্টে  পরিণত হয়। আমরা অবশ্যই কমরেডদের উৎসাহিত করবো সমগ্রের স্বার্থকে বিবেচনা করতে। সকল পার্টি সদস্য ও সকল বিভাগের কাজ, সকল ঘোষণা এবং কার্যকলাপ অবশ্যই সমগ্র পার্টির স্বার্থ থেকে শুরু হবে; এই নীতিকে লংঘন করা সম্পূর্ণভাবে অননুমোদনীয়।

এ ধরণের স্বতন্ত্রতার ধান্দায় ঘুরছেন এমন লোক সর্বদাই ‘আমি প্রথম’ নীতির সংগে অবিচ্ছেদ্য এবং তারা ব্যক্তিবিশেষ ও পার্টির মধ্যকার সম্পর্কের প্রশ্নে প্রায়ই ভুল করে থাকেন। তারা যদিও বুলিতে পার্টিকে সম্মান করেন কিন্তু কার্যতঃ নিজেদেরকেই প্রথম স্থান দেন এবং পার্টিকে দেন দ্বিতীয় স্থান। এ ধরনের লোক কিসের ধান্দায় ঘুরছেন? তারা খ্যাতি, পদ ও আত্মপ্রচারের জন্য ঘুরছেন। কাজের কোন এক অংশের দায়িত্ব তাদের দিলে তারা নিজেদের স্বতন্ত্রতার ধান্দায় থাকেন। এই উদ্দেশ্যে তারা কিছু লোককে পক্ষে টেনে আনেন, আর কিছু লোককে ঠেলে সরিয়ে রাখেন এবং কমরেডদের মধ্যে পরস্পরকে তোষামোদ ও টানাটানি করেন, তারা বুর্জোয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির ইতর রীতিকে কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে নিয়ে আসেন। তাদের অসততাই তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই আমাদের সৎভাবে কাজ করা উচিত। কারণ পৃথিবীতে কোন কাজ সম্পন্ন করতে হলে অসৎ মনোভাব দ্বারা তা করা একেবারে অসম্ভব। সৎ লোক কারা? মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাওসেতুঙ হলেন সৎ লোক। বৈজ্ঞানিক মনোভাবাপন্ন লোকই সৎ। অসৎ লোক কারা? ট্রটস্কী, বুখারিন, চেনতাও শিও, ক্রুশ্চেভ, ব্রেজনেভ, লিউশাওচি, জ্যোতি বসু, নম্বোদ্রিপাদ, মণি সিংহ, মোজাফফর, আব্দুল হক-তোয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন, দেবেন-বাশার, কাজী-রণো প্রভৃতি হলো অসৎ লোক। এরা ব্যক্তি বা চক্রের স্বার্থের ‘স্বতন্ত্রতা’ দাবী করে। সকল খারাপ লোক এবং যাদের কাজে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী নেই, নিজেদেরকে যারা খুব বুদ্ধিমান ও চালু বলে জাহির করে, আসলে কিন্তু এরা সকলে অতিশয় বোকা এবং তারা কোন ভাল কাজই করতে পারবে না। আমরা অবশ্যই একটি কেন্দ্রীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ পার্টি গঠন করবো এবং সকল প্রকার নীতিহীন উপদলীয় সংগ্রামকে সম্পূর্ণরূপে দূর করবো। আমরা অবশ্যই ব্যক্তিতাবাদ এবং বিভেদবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবো যাতে আমাদের সংগঠন একযোগে এগুতে পারে এবং লক্ষ্যের জন্য সংগ্রাম করতে পারে।

বাইরের ও স্থানীয় কেডারগণ অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হবেন এবং বিভেদপন্থী ঝোঁকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবেন। খুব গভীর মনোযোগ প্রদান করতে হবে বাইরের এবং স্থানীয় কেডারদের সম্পর্কের বিষয়ে। আমাদের কমরেডদের অবশ্যই বুঝতে হবে পার্টিকে গভীরভাবে শেকড় গাড়তে হলে স্থানীয় ও বাইরের কেডারদেরকে একত্র হতে হবে, ব্যাপকসংখ্যক স্থানীয় কেডারদের শিক্ষিত করতে হবে এবং পদোন্নতি করতে হবে। অন্যথায় এ কাজ করা অসম্ভব। বাইরের এবং স্থানীয় কেডার উভয়েরই শক্তিশালী ও দুর্বল দিক রয়েছে এবং কোনো উন্নতি করতে হলে তাঁরা অবশ্যই একে অপরের শক্তিশালী দিক থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন এবং নিজেদের দুর্বল দিকগুলো দূর করবেন। বাইরের থেকে আগত কেডারগণ স্থানীয় অবস্থা ও জনগণের সাথে সম্পর্কের বিষয় স্থানীয় কেডারদের মত অতটা অবগত নন। অধিকন্তু একই অঞ্চলের মধ্যে কোন অংশ দ্রুত এগিয়ে যায়, কোনটা পশ্চাতে পড়ে রয় বলে একস্থানের কেডারদের সাথে অন্য স্থানের কেডারদের পার্থক্য দেখা দেয়। অধিক উন্নত অংশ থেকে আগত কেডারগণও অনুন্নত অংশের স্থানীয় কেডারদের তুলনায় বাইরের কেডার। তাঁরাও মনোযোগ দেবেন স্থানীয় কেডারদের উন্নত করতে এবং বিকাশ ঘটাতে। সাধারণভাবে যে সকল স্থানে বাইরের কেডারগণ দায়িত্বে রয়েছেন সেখানে যদি স্থানীয় কেডারদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয় তবে প্রধানতঃ তাঁরাই দায়ী থাকবেন। প্রধান কমরেডগণ যাঁরা দায়িত্বে আছেন তাঁরাই অধিকতর দায়িত্ব বহন করবেন। কোন কোন স্থানে এ বিষয়ে যে নজর দেওয়া হচ্ছে তা প্রচুর নয়। কেউ কেউ স্থানীয় কেডারদের ছোট করে দেখেন এবং তাঁদের বিদ্রুপ করেন এই বলে, “এই সকল স্থানীয়রা কি জানে? যত সব বোকার দল।” এই ধরনের লোক স্থানীয় কেডারদের গুরুত্ব বুঝতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হন; তাঁরা স্থানীয় কেডারদের শক্তিশালী দিক বা নিজের দুর্বল দিক কোনটাই দেখেন না এবং একটা বিভেদপন্থী ভুল দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করেন। বাইরের সকল কেডার অবশ্যই স্থানীয় কেডারদের ভালবাসবেন এবং তাঁদেরকে সর্বদাই সাহায্য করবেন এবং তাঁরা অবশ্যই অনুমতি পাবেন না তাঁদেরকে আক্রমণ বা বিদ্রুপ করতে। নিশ্চয়ই স্থানীয় কেডারগণ তাঁদের দিক থেকে বাইরের কেডারদের শক্তিশালী দিক থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন এবং অপ্রয়োজনীয় সংকীর্ণ মনোভাব দূর করবেন, যাতে তাঁরা এবং বাইরের কেডারগণ এক হতে পারেন এবং ‘আমাদের’ ও ‘তাঁদের’ মধ্যে কোন পার্থক্য না থাকে এবং এভাবে বিভেদপন্থী মনোভাব দূর হয়।

একইভাবে এটা প্রয়োগ করতে হবে বাহিনীর কেডার এবং অন্যান্য কেডার, যারা স্থানীয়ভাবে কাজ করছেন তাঁদের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে। তাঁরা অবশ্যই সম্পূর্ণভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকবেন এবং বিভেদপন্থী ঝোঁককে দূর করবেন। বাহিনীর কেডারগণ অবশ্যই স্থানীয় কেডারদের সাহায্য করবেন, আবার স্থানীয় কেডারগণ বাহিনীর কেডারদের সাহায্য করবেন। যদি তাঁদের মাঝে গোলমাল বাধে তবে তাঁরা একে অপরের জন্যে কিছুটা ছেড়ে দেবেন এবং প্রয়োজনীয় আত্মসমালোচনা করবেন। সাধারণভাবে বলতে গেলে যে সকল স্থানে বাহিনীর কেডারগণ নেতৃত্বে আছেন তাঁরাই প্রধানতঃ দায়ী হবেন যদি স্থানীয় কেডারদের সাথে সম্পর্ক ভাল না হয়। যখন বাহিনী কেডাররা তাঁদের দায়িত্ব ভালভাবে বোঝেন এবং স্থানীয় কেডারদের প্রতি তারা সঠিক মনোভাব পোষণ করেন, কেবলমাত্র তখনই আমাদের কাজের সুন্দর অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

একই বিষয় প্রয়োগ করা যায় বিভিন্ন বাহিনী ইউনিট, বিভিন্ন স্থান এবং বিভাগের সম্পর্কের ক্ষেত্রে। আমরা অবশ্যই স্বার্থপর স্ববিভাগীয়বাদের বিরোধিতা করবো, যা দ্বারা নিজস্ব ইউনিটের স্বার্থকে দেখা হয় অন্যান্য ইউনিটের স্বার্থকে উপেক্ষা করে। যারাই অন্যের অসুবিধার প্রতি উদাসীন, অন্য ইউনিটের অনুরোধে কেডার বদলী করতে নারাজ অথবা বদলী করলেও নিম্নমানের কেডারদের বদলী করেন, যারা ‘প্রতিবেশীর জমিকে উদ্বৃত্ত জল নিষ্কাশনের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করেন’ এবং অন্য বিভাগ, স্থান বা লোকের প্রতি সামান্যতম মনোযোগও প্রদর্শনও করেন না–এ ধরনের লোক হলো স্বার্থপর স্ববিভাগীয়বাদী যারা কমিউনিজমের সামান্যতম মনোভাবও হারিয়েছে। সমগ্রকে বিবেচনা না করা এবং অন্য বিভাগ বা স্থান এবং জনগণের প্রতি সম্পূর্ণ অমনোযোগ প্রদর্শন করা প্রভৃতি হলো স্বার্থপর স্ববিভাগীয়বাদীদের চরিত্র। আমরা অবশ্যই আমাদের প্রচেষ্টাকে তীব্রতর করবো এ ধরণের লোকদের শিক্ষিত করার জন্য এবং তাদেরকে বুঝাবার জন্য যে, স্বার্থপর স্ববিভাগীয়বাদ হচ্ছে বিভেদমুলক মনোভাব যা খুবই ভয়াবহ পরিণতির সৃষ্টি করবে যদি তাকে বাড়তে দেওয়া হয়।

অপর এক সমস্যা হলো নতুন ও পুরাতন কেডারদের মধ্যকার সম্পর্ক। সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির (বলশেভিক) অষ্টম কংগ্রেসে কমরেড স্ট্যালিন বলেছেন, “কখনই প্রচুর পরিমাণে পুরোনো কেডার ছিলনা: যা রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম এবং এদের কিছু অংশ ইতিমধ্যেই প্রকৃতির নিয়মের প্রক্রিয়ায় বাতিল হয়ে গেছে” এখানে তিনি কেডারদের অবস্থার কথা বলেছিলেন, শুধু প্রকৃতির কথাই নয়। যদি আমাদের পার্টিতে প্রচুর পরিমাণে নতুন কেডার না থাকে যারা পুরোনোদের সাথে সহযোগিতার সঙ্গে কাজ করছে, তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য থেমে যাবে। তাই সমস্ত পুরোনো কেডারদেরকে পরম উৎসাহের সঙ্গে নতুন কেডারদেরকে স্বাগত জানাতে হবে, তাঁদের যত্ন নিতে হবে। সত্যি নতুন কেডারদের ত্রুটি রয়েছে, বিপ্লবে তাঁরা যোগ দিয়েছেন বেশী দিন হয়নি, তাঁদের অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ অপরিহার্যভাবেই পুরোনো সমাজের অস্বাস্থ্যকর মতাদর্শের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে এসেছেন, এটা ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর ব্যক্তিতাবাদী চিন্তাধারার অবশিষ্টাংশ, কিন্তু এই ত্রুটিগুলো শিক্ষা আর বিপ্লবের অগ্নিপরীক্ষার ভেতর দিয়ে দূর করা যেতে পারে। যেমন স্ট্যালিন বলেছেন, তাঁদের সদগুণ হচ্ছে যাকিছু নতুন সেসব বিষয়ের প্রতি তাঁদের বোধশক্তি অত্যন্ত সূক্ষ্ণ তাই তাঁরা অত্যন্ত বেশী উদ্দীপ্ত সক্রিয় কিন্তু কোনো কোনো পুরনো কেডারদের মধ্যে রয়েছে ঠিক সেই গুনেরই অভাব। নতুন ও পুরোনো কেডারদের পরস্পরকে সম্মান করা, পরস্পর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা, অন্যের সদগুণ থেকে শিক্ষা নিয়ে ত্রুটি অতিক্রম করা উচিত যাতে করে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে অভিন্ন কার্য সাধন করতে পারেন এবং বিভেদপন্থী ঝোঁককে ঠেকাতে পারেন। সাধারণভাবে বলতে গেলে যেখানে পুরোনো কমরেডরা দায়িত্বে রয়েছেন সেখানে যদি নতুন কেডারদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয় তবে প্রধানতঃ তাঁরাই দায়ী হবেন।

উপরের সবগুলো — অংশ এবং সমগ্রের মধ্যকার সম্পর্ক, ব্যক্তি এবং সংগঠনের মধ্যকার সম্পর্ক, বাইরের এবং স্থানীয় কেডারদের মধ্যকার সম্পর্ক, সামরিক কেডার এবং স্থানীয় কার্যরত কেডারদের মধ্যকার সম্পর্ক, এক সামরিক ইউনিটের সাথে অন্য সামরিক ইউনিটের সম্পর্ক, এক স্থানের সাথে অন্য স্থানের, এক বিভাগের সাথে অন্য বিভাগের এবং নতুন ও পুরোনো কেডারদের মধ্যকার সম্পর্ক — হলো পার্টির অভ্যন্তরস্ত সম্পর্ক। এ সকল সম্পর্কের ক্ষেত্রে কমিউনিজমের মনোভাবকে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন এবং বিভেদপন্থী ঝোঁকের বিরুদ্ধে পাহাড়া দেওয়া দরকার, যাতে আমাদের বাহিনী ভাল অবস্থায় থাকে, একই সঙ্গে এগোয় এবং ভালভাবে যুদ্ধ করে। বিভেদপন্থীবাদ হলো সাংগঠনিক ক্ষেত্রে আত্মগতভাবের প্রকাশ। যদি আমরা আত্মগতভাব দূর করতে চাই এবং বাস্তব থেকে সত্য খুঁজে বের করার মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার মনোভাবকে এগিয়ে নিতে চাই তবে আমরা অবশ্যই পার্টি থেকে বিভেদপন্থীবাদকে ঝেঁটিয়ে দূর করবো এবং পার্টির স্বার্থকে ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র দলের স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ার নীতি সামনে রেখে অগ্রসর হবো, যার ফলে পার্টির মাঝে সম্পূর্ণ একতা ও সংহতি স্থাপিত হয়।

বিভেদপন্থীবাদ পার্টির অভ্যন্তরস্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রের মত পার্টির সাথে বাইরের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও দূর করতে হবে। এর কারণ, আমরা শত্রুকে পরাজিত করতে সক্ষম হবো না কেবলমাত্র সমগ্র পার্টির কমরেডদের একত্রিত করে; সমগ্র দেশের জনগণকে একত্রিত করেই আমরা শত্রুকে পরাজিত করতে পারবো। কিছুকাল ধরে আমরা পার্টির নেতৃত্বে জনগণকে একত্রিত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। এ সময়ের মধ্যে আমরা লক্ষ্য করেছি আমাদের অনেক কমরেডের মাঝেই বিভেদপন্থী ঝোঁক রয়ে গেছে। আমাদের অনেক কমরেডেরই পার্টির বাইরের লোকদের সাথে ব্যবহারে ঔদ্ধত্য (overbearing) প্রকাশ পায়, তাদেরকে তারা হেয় ভাবেন, ঘৃণা করেন বা সম্মান প্রদর্শন করেন না অথবা তাদের শক্তিশালী দিককে প্রশংসা করেন না। এটা সত্যিই বিভেদপন্থী ঝোঁক। কয়েকটা মার্কসবাদী বই পড়ে এই কমরেডরা আরো বিনয়ী হওয়ার পরিবর্তে অহংকারী হন এবং অন্যকে খারাপ বলে বাতিল করে দেন; কিন্তু একবারও চিন্তা করেন না যে তাদের নিজেদের চিন্তাই আধা কাঁচা। আমাদের কমরেডদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে, কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যরা সর্বদাই সংখ্যালঘু। কাজেই আমাদের কি কারণ থাকতে পারে পার্টি-বহির্ভূত লোকদের সাথে ঐক্যবদ্ধ না হওয়ার? ঐ সকল লোক যারা আমাদের সাথে সহযোগিতা করেন বা ভবিষ্যতে করতে পারেন, আমাদের কর্তব্য হলো তাদের সঙ্গে একত্রিত হওয়া; কোন অধিকারই নেই তাদেরকে বাদ দেওয়ার। কিন্তু কিছু কিছু পার্টি সদস্য এটা বোঝেন না এবং যারা আমাদের সাথে সহযোগিতা করতে চান তাদেরকে নীচুভাবে দেখেন বা তাদেরকে বাদ দেন। এইরূপ করার কোন কারণই নেই। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাওসেতুঙ কি আমাদের এইরূপ করার কোন যৌক্তিকতা দিয়েছেন?  না, তাঁরাও দেননি। উপরন্তু তাঁরা বারবার আমাদের বলেছেন জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সৃষ্টি করতে এবং নিজেদেরকে তাদের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন না করতে। আমাদের প্রস্তাবাবলীর একটিতেও নেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কথা; উপরন্তু, কেন্দ্রীয় সংস্থা আমাদের সর্বদাই বলেছেন জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করতে এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন না হতে। এভাবে যে কোন কাজ যা আমাদেরকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার কোন যৌক্তিকতা নেই এবং এটা আমাদের কিছু কমরেড-সৃষ্ট বিভেদপন্থী মনোভাবের ফল। যেহেতু এই বিভেদপন্থীবাদ আমাদের কিছু কিছু কমরেডের মাঝে রয়েছে এবং এটা পার্টি লাইন প্রয়োগে বাঁধা সৃষ্টি করে, এ কারণে আমরা পার্টির অভ্যন্তরে তীব্রভাবে শিক্ষা চালাবো এই সমস্যার মোকাবেলা করতে। সবচাইতে বড় কথা হলো, আমরা আমাদের কেডারদের বোঝাবো সমস্যাটি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ এবং পার্টি বহির্ভূত কেডার ও জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধ না হলে শত্রুদের উৎখাত করা ও বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জন করা কতখানি অসম্ভব।

সকল বিভেদপন্থী ধারণা হলো আত্মগতভাব এবং এগুলো বিপ্লবের প্রয়োজনের পরিপন্থী। এ কারণে বিভেদপন্থীবাদের বিরুদ্ধে ও আত্মগতভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম একযোগে চলবে।

আত্মগতভাব দূর করার জন্য আমরা অবশ্যই বস্তুবাদ ও দ্বান্দ্বিকতার প্রচার করবো। আমাদের সংগঠনের কিছু লোক রয়েছেন যারা বস্তুবাদ ও দ্বান্দ্বিকতার প্রচারে কোন গুরুত্ব দেন না, তারা ভাবেন যে, তারা মার্কসবাদে বিশ্বাসী  কিন্তু তারা কোন প্রচেষ্টা চালান না বস্তুবাদ বুঝতে অথবা যখন তারা কোন আত্মগত কিছু দেখেন বা পড়েন তখন তারা কোন মতামত পেশ করেন না বা সমালোচনা করেন না। এটা কমিউনিস্টদের চরিত্র নয়। এটা আমাদের কমিউনিস্টদের মন আত্মগতভাব দ্বারা বিষাক্ত করে ফেলে এবং মনের স্পর্শকাতরতাবোধকে ভোঁতা করে দেয়। এ কারণে আমরা সংগঠনের মাঝে একটি শিক্ষার আন্দোলন পরিচালনা করবো যা আমাদের কমরেডদের মন থেকে আত্মগতভাবের এবং বিভেদপন্থীবাদের কুয়াশা দূর করবে। আমরা অবশ্যই আত্মগতভাব ও বিভেদপন্থীবাদ অকেজো মাল হিসেবে বর্জন করবো এবং তাদের প্রসার বন্ধ করবো এবং পার্টির কর্মীদের তাত্ত্বিক নিম্নমানের সুযোগ প্রদান রোধ করবো। আমাদের কমরেডগণ এ কারণে একটি ভাল নাক তৈরী করবেন। সকল বিষয়ের ঘ্রাণ নেবেন এবং বিষয়টিকে স্বাগত জানাবেন না বর্জন করবেন তা নির্ণয়ের জন্য খারাপ ও ভালর মধ্যে পার্থক্যরেখা টানবেন। কমিউনিস্টরা সর্বদাই প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন, ‘কেন’ ও ‘কোথা থেকে’ বলে। তাদের নিজেদের মাথা খাটাবেন এবং সতর্কতার সাথে চিন্তা করবেন, এটা বাস্তবের সাথে খাপ খায় কিনা এবং এটা বাস্তবের উপর সত্যিকারভাবে প্রতিষ্ঠিত কিনা; কোন অবস্থায়ই অন্ধভাবে তারা অনুসরণ করবেন না বা দাসত্ববাদের উৎসাহ দেবেন না।

শেষ করতে যেয়ে বলা যায়, আত্মগতভাব এবং বিভেদপন্থীবাদ বিরোধিতার সময় আমাদের দুটো লক্ষ্য থাকবে। প্রথম হলো– “অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন ভবিষ্যতের ভুল এড়ানোর জন্য” এবং দ্বিতীয় হলো- “রোগ সারিয়ে রোগীকে বাঁচান”।

মুখ না দেখে অতীতের ভুলগুলো অবশ্যই প্রকাশ করে দিতে হবে; অতীতের খারাপ বস্তুকে বৈজ্ঞানিক মনোভাব দিয়ে বিশ্লেষণ করা ও সমালোচনা করা প্রয়োজন, যাতে করে ভবিষ্যতের কাজ আরো সতর্কতার সঙ্গে ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়। এটাই হচ্ছে “অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের ভুল এড়ানোর” অর্থ। কিন্তু ভুল উদঘাটন করার ও ত্রুটি সমালোচনা করার আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে যেমন চিকিৎসক রোগীর চিকিৎসা করেন। সম্পূর্ণভাবে রোগীকে বাঁচানোর জন্য–তাকে মেরে ফেলার জন্য নয়। একজন ‘এপেন্ডিসাইটিস’ রোগে ভুগছে এমন ব্যক্তির উপাংগটি চিকিৎসক যদি কেটে দেন তখনই সে বাঁচে। কোন লোক ভুল করার পর যদি চিকিৎসার ভয় না করে, রোগকে গোপন না রাখে, ভুলকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে না ধরে, চিকিৎসার সাধ্যাতীত অবস্থায় না পড়ে এবং সত্যি সত্যি আন্তরিকভাবে চিকিৎসা করতে চায় এবং ভুল শোধরাতে ইচ্ছুক থাকে তবে আমাদের উচিত তাকে স্বাগত জানানো ও তার রোগ সারানো, যাতে সে একজন ভাল কমরেড হয়ে উঠে। যদি ক্ষণিক আত্মতুষ্টির জন্য তখনই তীব্র কশাঘাত করা হয়, তাহলে এ কাজ কখনও সফল হবে না। মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক ব্যাধির চিকিৎসায় কখনো রুক্ষ ও বেপরোয়া মনোভাব গ্রহণ করা উচিত নয়, বরং “রোগ সারিয়ে রোগীকে বাঁচানো”, এই মনোভাবে অবশ্যই গ্রহণ করা উচিত–শুধু এটাই নির্ভুল ও ফলপ্রদ পদ্ধতি। ■