সিরাজ সিকদার রচনাঃ ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শের প্রকাশ সম্পর্কে


সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার

 


পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন কর্তৃক প্রনীত ও  প্রকাশিত হয় ১৯৬৮-৭০ সময়কালে

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক  ”ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী-উদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কে পুস্তিকায়  এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে

পূবাসপা কর্তৃক নির্বাচিত মতাদর্শগত রচনাবলীতে এর প্রকাশ কাল ১৯৭৪

সিপিএমএলএম বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com)-এর অনলাইন প্রকাশনা ৪ ডিসেম্বর ২০১২


পিডিএফ

সভাপতি মাও সেতুঙ-এর “পার্টি ইতিহাসের প্রশ্নে প্রস্তাব” রচনার ভিত্তিতে

 

প্রথমঃ চিন্তার ক্ষেত্রে

ক্ষুদে বুর্জোয়া চিন্তার পদ্ধতি প্রকাশ পায়— আত্মগত এবং একতরফাভাবে সমস্যা দেখার মাঝে অর্থাৎ এটা শ্রেণীসমূহের শক্তির ভারসাম্যের চিত্র বস্তুগতভাবে এবং সামগ্রিকভাবে না দেখে আত্মগত ইচ্ছা, ধারণা এবং ফাঁকা বুলিকে বাস্তব বলে গ্রহণ করে, একটি দিককে সকল দিক, অংশকে সমগ্র এবং বৃক্ষকে অরণ্য বলে ধরে নেয়। বাস্তব উৎপাদনের পদ্ধতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের শুধু বইয়ের জ্ঞান রয়েছে কিন্তু ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের অভাব রয়েছে এবং এ কারণে তাদের চিন্তার পদ্ধতি গোড়ামীবাদ রূপে প্রকাশ পায়। উৎপাদনের সাথে জড়িত ক্ষুদে বুর্জোয়াদের যদিও কিছু ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান রয়েছে কিন্তু তবুও তারা ক্ষুদে বুর্জোয়া উৎপাদনের সীমাবদ্ধতার চরিত্র-সংকীর্ণতা, ভাসাভাসাভাব, বিচ্ছিন্নতা এবং গোড়ামীবাদ প্রভৃতিতে ভোগে এবং এ কারণে তাদের চিন্তার পদ্ধতি প্রায়ই সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ হিসেবে প্রকাশ পায়।

দ্বিতীয়ঃ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষুদে বুর্জোয়াভাব প্রায়ই বাম এবং ডানের মধ্যে দোদুল্যমানতায় প্রকাশ পায়। এর কারণ তাদের জীবনধারণের পদ্ধতি ও তা থেকে সৃষ্ট আত্মগত ও একতরফাবাদী চিন্তাধারার পদ্ধতি। বহু ক্ষুদে বুর্জোয়া বিপ্লবী বিপ্লবের দ্রুত বিজয়ের আশা পোষণ করে যাতে তাদের জীবনযাত্রার মানের একটি আশু পরিবর্তন হয়। এ কারণে তারা দীর্ঘস্থায়ী বিপ্লবী কাজে ধৈর্যের অভাবে ভোগে এবং ‘বামপন্থী’, ‘বিপ্লবী বুলি’ ও শ্লোগানকে পছন্দ করে এবং মানসিকতায় ও কাজে তারা রুদ্ধদ্বারনীতি বা হঠকারীতাবাদের শিকারে পরিণত হয়। পার্টির মাঝে এই ক্ষুদে বুর্জোয়া মনোভাব বহু প্রকার বাম বিচ্যুতির লাইন হিসেবে প্রকাশ পায়; যেমন নিম্নলিখিত ক্ষেত্রেঃ বিপ্লবের লক্ষ্য, বিপ্লবী ঘাঁটি, কৌশল এবং সামরিক লাইন প্রভৃতি। পূর্বের ক্ষুদে বুর্জোয়া বিপ্লবীরা বা বিপ্লবীদের অপর অংশ যখন অন্য ধরণের পরিস্থিতিতে পড়ে তখন তারা হতাশ এবং নিরাশ হয়ে যেতে পারে এবং দক্ষিণপন্থী মনোভাব এবং মতামত প্রকাশ করে বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তি করতে পারে। চীনে ১৯২৪-২৭ সালের শেষের দিকে চেনতুশিউবাদ রূপে, কৃষি বিপ্লবের শেষের দিকে চেনকাওতাওবাদ রূপে এবং লং মার্চের প্রথম দিকে যুদ্ধবাদ রূপে ক্ষুদে বুর্জোয়া দক্ষিণপন্থী চিন্তাধারা প্রকাশ পায়। জাপানবিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধের সময় আপোষপন্থী মনোভাব পুনরায় প্রকাশ পায়। সাধারণভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, যখন বুর্জোয়া ও সর্বহারাদের বিচ্ছেদ ঘটে তখন বামপন্থী বিচ্যুতি ঘটার বিশেষ সম্ভাবনা থাকে। উদাহারণস্বরূপ চীনা পার্টিতে কৃষি বিপ্লবের সময় তিনবার পার্টির নেতৃত্বসংস্থায় বামপন্থী লাইন প্রাধান্য পেয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতি ঘটার অধিক সম্ভাবনা থাকে যখন বুর্জোয়া ও সর্বহারাদের মাঝে মৈত্রী হয়। যেমন চীনে ১৯২৪-২৭ সালে বিপ্লবের শেষের দিকে এবং জাপান বিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রথম দিকে। বাম বা ডান যাই হোক না কেন এই বিচ্যুতি বিপ্লবকে সাহায্য করেনা বরং প্রতিবিপ্লবকে সাহায্য করে। বাম বা ডানে দোদুল্যমানতা, চরমে যাওয়ার ইচ্ছা, সারবস্তুহীন অথচ নিজেকে কেউকেটা বলে প্রকাশ করা, জঘন্য সুবিধাবাদ এগুলি সবই প্রকাশ পায় পরিবর্তনশীল অবস্থার চাপে। ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শের এগুলো খারাপ দিক। এগুলো সকলই ক্ষুদে বুর্জোয়াদের অদৃঢ় অর্থনৈতিক অবস্থার মতাদর্শগত ক্ষেত্রের উপর প্রভাব।

তৃতীয়ঃ সাংগঠনিক ক্ষেত্রে

সাধারণভাবে ক্ষুদে বুর্জোয়াদের জীবনধারণের ক্ষেত্রে এবং চিন্তার পদ্ধতিতে সীমাবদ্ধতা এবং বিশেষভাবে দেশে পশ্চাদপদ অবস্থা এবং গোষ্ঠী ও পরিবারের বিকেন্দ্রিক সামাজিক অবস্থা সাংগঠনিক জীবনে ক্ষুদে বুর্জোয়া চিন্তাধারা, ব্যক্তিতাবাদ এবং বিভেদপন্থীবাদ প্রভৃতি রূপে প্রকাশ পায়। পার্টিকে ইহা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এই মনোভাব সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বামপন্থী বিচ্যুতিপূর্ণ সাংগঠনিক লাইন হিসেবে প্রকাশ পায়। এই মনোভাবে নিঃস্বার্থভাবে জনগণ ও পার্টির জন্য কাজ না করে পার্টি ও জনগণের শক্তির সুযোগ গ্রহণ করে এবং পার্টি ও জনগণের স্বার্থকে নিজস্ব বা দলগত স্বার্থে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই কারণে ইহা জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা এবং পার্টির শৃংখলার নীতির পরিপন্থী। এই মনোভাব প্রায়ই প্রকাশ পায় নিম্নরূপে—

আমলাতন্ত্র, পিতৃতন্ত্র, দমননীতি, হুকুমবাদ, ব্যক্তিবিশেষের বীরত্ববাদ, আধা-নৈরাজ্যবাদ, উদারতাবাদ, উগ্রগণতন্ত্র, স্বাতন্ত্র্য দাবী করা, গিল্ড মনোভাব, শক্তিশালী দুর্গের মনোভাব, নিজ শহরের লোক এবং সহপাঠির জন্য পক্ষপাত (Favouritism), উপদলীয় গোলমাল এবং বদমাইশী কৌশল প্রভৃতি। ঐ সকলই জনগণের সাথে পার্টির সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং অভ্যন্তরস্থ ঐক্য বিনষ্ট করে।

ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শের এগুলি হচ্ছে তিনটি দিক—মতাদর্শের ক্ষেত্রে আত্মগতভাব, রাজনীতির ক্ষেত্রে দক্ষিণ ও বাম বিচ্যুতি এবং সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বিভেদপন্থীবাদ যা সকলই বিভিন্ন সময়ে পার্টিতে প্রকাশ পায়। পার্টির ক্ষমতা দখল করা এবং একটি সুসংবদ্ধ লাইন যে ভাবেই প্রকাশ পাক না কেন এগুলি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ বিরোধী ক্ষুদে বুর্জোয়া মনোভাবের প্রকাশ। পার্টি ও জনগণের স্বার্থে অবশ্যই প্রয়োজন শিক্ষার পদ্ধতি দ্বারা পার্টির মধ্যকার ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শকে বিশ্লেষণ করা ও তা অতিক্রম করা এবং একে পরিবর্তন করে সর্বহারার মতাদর্শে রূপান্তরিত করার জন্য সাহায্য করা। ■