সিরাজ সিকদার রচনাঃ ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী উদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কে

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার


পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন এর এই দলিলটি সংগঠন কর্তৃক তাত্ত্বিক পত্রিকা “লাল ঝাণ্ডা”য় সম্ভাব্য প্রকাশকাল ১৯৬৮-৭০

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক  ”ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী-উদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন সম্পর্কে পুস্তিকায়  এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে

পূবাসপা কর্তৃক নির্বাচিত মতাদর্শগত রচনাবলীতে এর প্রকাশ কাল ১৯৭৪

সিপিএমএলএম বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com)-এর অনলাইন প্রকাশনা ৪ ডিসেম্বর ২০১২


পিডিএফ

মাও সেতুঙের উদ্ধৃতি

“সাংগঠনিকভাবে বিষয়গুলি ঠিক করতে হলে প্রথম প্রয়োজন মতাদর্শগতভাবে সব ঠিক করা, প্রয়োজন সর্বহারা মতাদর্শ দ্বারা অসর্বহারা মতাদর্শের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করা

“আমরা অবশ্যই নিপুণ হবো পার্টির অভ্যন্তরে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শপূর্ণ লোকদের সর্বহারা বিপ্লবের পথে পরিচালনা করতে

ঔপনিবেশিক আধা-সামন্তবাদী পূর্ববাংলার জনগণের অধিকাংশই ক্ষুদে বর্জোয়া, অর্থাৎ কৃষক, বুদ্ধিজীবি, ক্ষুদে চাকুরীজীবী, দোকানদার, হস্তশিল্পী প্রভৃতি। ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী “পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন”কে শুধু-যে ঘিরে আছে তা নয়, এর অধিকাংশ সদস্যই এই শ্রেণী উদ্ভূত। এর কারণ ক্ষুদে বুর্জোয়া গণতন্ত্রমণা বিপ্লবীরা নিজেদের অর্থনৈতিক অসুবিধা থেকে মুক্তির আর কোন পথ না পেয়ে এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও সেতুঙ চিন্তাধারার বিশ্বব্যাপী বিজয়ে প্রভাবান্বিত হয়ে সর্বহারার নেতৃত্ব গ্রহণ করছে। অধিকন্তু পূর্ববাংলার বর্তমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় শ্রমিক জনতা ও শ্রমিক শ্রেণী থেকে আগত পার্টি সদস্যদেরও ক্ষুদে বুর্জোয়া ছাপ রয়েছে। এ কারণে এটা মোটেই আশ্চর্যজনক নয় বরং অবশ্যম্ভাবী যে, ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ সংগঠনে বিভিন্ন আকৃতি ও রূপ নিয়ে প্রকাশ পাবে।

ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী পূর্ববাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের একটি মৌলিক পরিচালক শক্তি, কেননা এরা বিভিন্নভাবে শোষিত হয়ে প্রতিনিয়ত দ্রুততর গতিতে গরীব, দেউলিয়া বা বেকার হয়ে যাচ্ছে এবং তাদের অতিসত্বর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু পরিবর্তনশীল শ্রেণী হিসেবে এর দ্বিমুখী চরিত্র রয়েছে। এর ভালো ও বিপ্লবী দিক হলো যে, এই শ্রেণীর অধিকাংশ সদস্যই সর্বহারার রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক এমনকি মতাদর্শগত প্রভাবকেও সহজেই গ্রহণ করে। বর্তমানে তারা জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব চায় এবং এর জন্য তারা ঐক্যবদ্ধ হতে ও সংগ্রাম করতে সক্ষম এবং ভবিষ্যতেও তারা সর্বহারার সাথে সমাজতন্ত্রের পথ গ্রহণ করতে পারে।

তাদের খারাপ ও পশ্চাদপদ দিক হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণীর তুলনায় এ শ্রেণীর শুধু-যে বহু দুর্বল দিক রয়েছে তাই নয়, যখন তারা সর্বহারার নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয় তখন তারা প্রায়ই বিগড়ে যায় এবং উদারনৈতিক বুর্জোয়া, এমনকি বড় বুর্জোয়াদের প্রভাবে পড়ে এবং তাদের স্বার্থ উদ্ধারের শিকারে পরিণত হয়। অতএব বর্তমান পর্যায়ে সর্বহারা ও তাদের অগ্রগামী সংগঠন “পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন” নিজেকে পার্টি বহির্ভূত ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে একটি সুদৃঢ় এবং ব্যাপক মিত্রতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করবে এবং একদিকে তাদের সাথে ব্যবহারে নমনীয় হবে, তাদের উদারনৈতিক ধারণা এবং কর্মপদ্ধতিকে সহ্য করবে যতক্ষণ তা শত্রুবিরোধী সংগ্রাম বা জনগণের সাধারণ জীবনযাত্রার ক্ষতি না করে এবং অন্যদিকে তাদেরকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদান করবে যাতে তাদের সাথে মিত্রতা দৃঢ় হয়।

কিন্তু ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী উদ্ভূত লোক যারা স্বেচ্ছায় তাদের শ্রেণী ত্যাগ করেছেন এবং সর্বহারার সংগঠনে যোগ দিয়েছেন, পার্টি তাদের বেলায় সংগঠন বহির্ভূত ক্ষুদে বুর্জোয়াদের তুলনায় অন্য ধরনের নীতি গ্রহণ করবে। যেহেতু এ ধরনের লোক শুরু থেকেই পার্টির খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং স্বেচ্ছায় পার্টিতে যোগ দিয়েছেন, তারা ধীরে ধীরে পার্টির মাঝে মার্কসবাদী শিক্ষার মাধ্যমে এবং বিপ্লবী গণসংগ্রামে পোড় খেয়ে মতাদর্শগত ক্ষেত্রে সর্বহারা হতে পারেন এবং সর্বহারার স্বার্থের ভাল সেবা করতে পারেন।

আমাদের সংগঠনের বহু ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী-উদ্ভূত কর্মী পার্টি ও জনগণের জন্য বীরত্বের সাথে সংগ্রাম করেছেন, তাঁরা বহু ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং মতাদর্শগতভাবে ধীরে ধীরে উন্নত হয়ে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হয়েছেন।

এটা অবশ্যই জোর দেওয়া প্রয়োজন যে, সর্বহারাকরণ হয়নি এইরূপ ক্ষুদে বুর্জোয়াদের বিপ্লবী চরিত্র সর্বহারার বিপ্লবী চরিত্র থেকে মূলগতভাবে পৃথক এবং এ পার্থক্য বৈরীরূপ গ্রহণ করতে পারে। ক্ষুদে বুর্জোয়া বিপ্লবী চরিত্রসম্পন্ন পার্টি সদস্য যাঁরা পার্টিতে যোগ দিয়েছেন সাংগঠনিকভাবে কিন্তু মতাদর্শগতভাবে নয়, অথবা সম্পূর্ণভাবে নয়, তারা প্রায়ই মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মুখোশ নিয়ে উদারতাবাদী, সংস্কারবাদী, নৈরাজ্যবাদী, সংশোধনবাদী, ট্রটস্কী-চেবাদী, ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী ও প্রতারকে পরিণত হয়। এইরূপ অবস্থায় তাদের দ্বারা আগামী দিনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা শুধু-যে অসম্ভব তাই নয় বর্তমানের জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনাও অসম্ভব।

সর্বহারার অগ্রগামী কর্মীগণ যদি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শের সাথে কিছু কিছু পার্টি সদস্যদের ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর মতাদর্শের একটি দৃঢ় ও তীক্ষ্ণ পার্থক্যরেখা না টানেন এবং তাদের শিক্ষিত না করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে গুরুতররূপে কিন্তু যথাযথভাবে ও ধৈর্যের সাথে সংগ্রাম না করেন তবে অসম্ভব হবে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শকে অতিক্রম করা। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো এ সকল ক্ষুদে বুর্জোয়া সদস্য অবশ্যম্ভাবীভাবেই প্রচেষ্টা চালাবে সর্বহারার অগ্রগামী বাহিনীকে নিজ প্রতিকৃতি অনুযায়ী পরিবর্তিত করতে এবং পার্টির নেতৃত্ব দখল করতে। এভাবে তারা প্রচেষ্টা চালাবে পার্টি ও জনগণের উদ্দেশ্যের ক্ষতি সাধন করতে। পার্টির বাইরে যত বেশী ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী-উদ্ভূত সদস্য থাকবে, তত কঠোরভাবে পার্টি অবশ্যই বজায় রাখবে সর্বহারার অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে তার পবিত্রতা। এতে ব্যর্থ হলে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ পার্টিকে তীব্রভাবে আঘাত করবে এবং পার্টি ও জনগণের অধিক ক্ষতি সাধিত হবে।

কাজেই ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আগত পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা অবশ্যই নিজেদের বিপ্লবের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করবেন এবং অবগত হবেন কি কি বিশেষরূপে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ চিন্তার ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে ও সামরিক ক্ষেত্রে প্রকাশ পায়। তারা মতাদর্শগত ক্ষেত্রে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ-বিরোধী শ্রেণীসংগ্রামকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবেন এবং প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা চালাবেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, বিশেষ করে এ যুগের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে রপ্ত করতে, তা প্রয়োগ করতে এবং অধিকতরভাবে শ্রমিক, কৃষক ও শ্রমজীবী জনগণের সাথে একীভূত হতে। এভাবে অধ্যয়ন, প্রয়োগ ও গণসংগ্রামের বিপ্লবী চুল্লিতে পোড় খেয়ে তারা সক্ষম হবেন নিজেদের মতাদর্শের বিপ্লবীকরণ করতে এবং পূর্ববাংলা ও বিশ্বের নিপীড়িত জনগণকে অধিকতর নিঃস্বার্থভাবে সেবা করতে। ■