দেশে শিশু ও নারী নির্যাতনের সাম্প্রতিক চিত্র

লেখকঃ

হোসেন নীল

শিশু নির্যাতন

দেশের জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে ৬ কোটি শিশু। অর্থাৎ দেশের জনসংখ্যার ৪০% শিশু। অথচ তারা প্রতিদিন প্রতিমুহুর্ত ভয়ানক অত্যাচার নির্যাতন হত্যা ধর্ষণের শিকার।

দেশে শিশু নির্যাতন ও হত্যা ভয়ানকভাবে বেড়েছে। প্রচলিত রীতিনীতি, আচার আচরণ, আইনকানুন ও মূল্যবোধের গণহত্যাকারী এ এক চরম অমানবিক চরিত্র। সবাই দেখতে পাচ্ছে যে মাবাবার কোলও নিরাপদ নয়। পারিবারিক কলহ, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, ব্যক্তিগত লোভ লালসা চরিতার্থ, স্বার্থ আদায়ের জন্য শিশুদের টার্গেট করা হয়। বড়দের তৈরি সমাজ অসুস্থ। অসুস্থ সমাজে বড় হচ্ছে শিশুরা। বড়দের লোভ ও ক্ষোভের শিকার হচ্ছে শিশুরা। শিশুরা পরিবারের আদরণীয় হওয়ার তাদের টার্গেট করে তাদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে, টাকা না পেলে প্রায়ই হত্যা করে। শিশুরা দুর্বল বলে দুর্বৃত্তরা তাদের উপর কাপুরূষোচিত আঘাত হানতে পারে। মাবাবার উপর প্রতিশোধ, যৌন নিপীড়ণ, মুক্তিপন, জমি সংক্রান্ত বিরোধ, এমনকি আম পাড়ার মত তুচ্ছ অপরাধে, মাছ ধরার অপবাদ দিয়ে শিশুদের হত্যা করা হয়।গৃহকর্মী নির্যাতনের মাধ্যমে ঘটছে শিশুহত্যা। মেয়েশিশুরা ধর্ষণের স্বীকার হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। শিশুরা ধর্মীয় নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে ২০১৬ র প্রথম তিন মাসে ১৫২ শিশু হত্যাকান্ডের শিকার হয়। শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে চারবছরে ১০৮৫ শিশু হত্যা হয়েছে। তাদের তথ্যমতেঃ

২০১৫ সালে ২৯২ জন, ২০১৪ সালে ৩৬৬ জন ও ২০১৩ সালে ২১৮ জন এবং ২০১২ সালে ২০৯ জন হত্যার শিকার হয়। গত দুই বছরে মাবাবার হাতে খুন হয়েছে ৯০ জন শিশু।

২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ঢাকার বনশ্রীতে দুই ভাইবোন আলভী ও অরণী শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। মা মাহমুদা মালেক জেসমিনকে আসামী করা হয়। সামাজিক হতাশা থেকে মা

ঢাকার বনশ্রীতে নিহত দুই শিশু আলভী ও অরণী মায়ের সাথে

ঢাকার বনশ্রীতে নিহত দুই শিশু আলভী ও অরণী মায়ের সাথে

সন্তানদের হত্যা করেছে মাকে উদ্ধৃত করে এমন কথা র‍্যাবের তরফ থেকে বলা হলে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। তথাপি পাশবিক এই সমাজে এমন ঘটনাও ঘটতে পারে।

১৬ এপ্রিল ২০১৬ বরিশালের বানারীপাড়ায় ভাড়াটিয়া রিকশাচালক রিপন শেখের ছেলে ৩ বছরের শিশু হাফিজুরকে কান্না না থামানোর কারণে বাড়িঅলার স্ত্রী নুপুর বেগম আছাড় দিয়ে হত্যা করে।

সিলেটে সামিউল ইসলাম রাজনের পর নাটোরে গাছে বেঁধে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সুটকেসের ভেতর সারা শরীরে আয়রনের ছ্যাকা লাগা ৮/৯ বছরের গৃহকর্মীর লাশ পাওয়া যায়। চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে বাবা মা পিটিয়ে  শিশুকন্যা সুমাইয়াকে হত্যা করে শিশুটির মায়ের অলৌকিক ক্ষমতা প্রমাণ করতে। বহু শিশু ধর্মীয় নির্যাতনের স্বীকার হয়, ধর্মীয় কাজ না করলে ভয়ংকর নির্যাতন চালানো হয়। ভুত জ্বীন আছর করেছে এই কথা বলে নির্যাতন চালানো হয়।

হবিগঞ্জের বাহুবলে সুন্দ্রাটিকি গ্রামে  ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬তে হবিগঞ্জের বাহুবলের সুন্দ্রাটিকী গ্রামে এক পরিবারের চারশিশু শুভ (৯), তাজেল (১০), মনির (৭) ও ইসমাইল (১০)কে অপহরণ, গুম ও খুন করা হয়। প্রথম তিনজন আপন চাচাতো ভাই। চারদিন পর শ্রমিকরা বালু উত্তোলন করতে গেলে লাশ পায়। পঞ্চায়তের বিরোধের জেরে এ শিশুহত্যা করা হয়। ৮ পঞ্চায়েতের গ্রামে পঞ্চায়েতের টাকা লুটপাট, ভাগাভাগি দ্বন্দ্ব, এক

হবিগঞ্জের বাহুবলে পঞ্চায়েতের পারস্পরিক লোভ লালসার ফলে নির্মম হত্যার শিকার ৪ শিশু

হবিগঞ্জের বাহুবলে র সুন্দ্রাটিকি গ্রামে পঞ্চায়েতের পারস্পরিক লোভ লালসার ফলে নির্মম হত্যার শিকার ৪ শিশু

পঞ্চায়েতের উপর প্রতিশোধ, আরেক পঞ্চায়েতকে ফাঁসানো ইত্যাদি কারণে সম্ভবত ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে। পুলিশ প্রথমে অভিযোগ না নিয়ে দোয়া পড়া, তজবিহ পড়া ও মেলার খোঁজার পরামর্শ দেয়।

৮ ডিসেম্বর ২০১৫ বিকেলে ঢাকার শ্যামপুরে নীরব (৫) নামে এক শিশু খেলার সময় খোলা ম্যানহোলে পড়ে মারা যায়। বেশ কয়েকঘন্টা পর কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে ভেসে যাওয়া লাশ রাত সোয়া আটটার দিকে বুড়িগঙ্গার নর্দমার পানিতে পাওয়া

ঢাকার শ্যামপুরে ম্যানহোলে পড়ে নিহত শিশু নিরব

ঢাকার শ্যামপুরে ম্যানহোলে পড়ে নিহত শিশু নিরব

যায়।ম্যানহোল পরিষ্কার করে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ঢাকনা খোলা রেখেই চলে গিয়েছিল। এরকম হাজার হাজার ম্যানহোলে পড়ে শত শত শিশুর মৃত্যু হয়। এগুলো রাষ্ট্রীয় হত্যাকান্ডের দৃষ্টান্ত।

খুলনায় রাকিব শরিফ মটরসে নির্যাতনের কারণে কাজ ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র কাজ নিলে শরিফ মটর্সের মালিক শরিফ মিয়া ও তার ভাই

খুলনায় শরিফ মটরসের মালিকদের ভয়ংকর নির্যাতনে নিহত শিশু রাকিব

খুলনায় শরিফ মটরসের মালিকদের ভয়ংকর নির্যাতনে নিহত শিশু রাকিব

মিন্টু মিয়া রাকিবকে ভয়ংকর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে।

সিপিএমএলএম বাংলাদেশের দলিলে শিশু নির্যাতনের শ্রেণী প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে শিশুরা ইতিবাচক গুণের আধার। অথচ শ্রেণী সমাজে প্রতিটি শ্রেণীর শিশুই দমিত হয়। শিশুরা অন্যদের ভালবাসতে চায়, কোমল স্বভাব, প্রকৃতি ভালবাসে, বিজ্ঞান ভালবাসে, শিল্প ভালবাসে। তাদের এসব কিছুতে বাঁধা দেওয়া হয়। তাদের লোভ লালসা শিক্ষা গ্রহণে বাধ্য করা হয়, ধর্মবাদী কুসংস্কার পালনে বল প্রয়োগ করা হয়। শিশুরা বিদ্রোহ করে এবং তারাই আগামী দিনের সমাজবিপ্লবের যোদ্ধা। তাদের দমন করে কেউ রাখতে পারবে না।

নারী নির্যাতন

নারীরা জনসংখ্যার অর্ধেক।তাদেরকে দেখা হয় পুরুষের দাসী, অর্ধদাসী অথবা পন্য হিসেবে।

লঞ্চের কেবিনে, চলন্ত বাসে, থানায় অভিযোগ জানাতে এসে পুলিশ কর্তৃক ধর্ষিত নারী। নারী পুলিশ সহকর্মীদের দ্বারা ধর্ষিত। নির্জন রাস্তায় নারী শ্রমিক ধর্ষণ, বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার। শিশুরা, আদিবাসী নারী বা গৃহকর্মী ধর্ষণের শিকার। নারীরা গণধর্ষণের স্বীকার হচ্ছে।

পত্রিকা সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে আট বছরে ধর্ষণের শিকার ৪৩০৪ জন যাদের মধ্যে ৭৪০ জনকে হত্যা করা হয়েছে।

নারী ধর্ষণের ১% ও রেকর্ড হয়না। মান মর্যদা হারানোর ভয়ে অধিকাংশই চেপে যাওয়া হয়। পুলিশ দপ্তরে গত তিন বছরে ৬০০০০ এর বেশী নারী নির্যাতনের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে অবশ্য অনেক ভুয়া রেকর্ড আছে যার দ্বারা নিরপরাধ লোকের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়।

২০ মার্চ ২০১৬ রাতে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে উদ্ধার হয় ভিক্টোরিয়া কলেজের

প্রগতিশীল নাট্যকর্মী তনু ধর্ষণের পর হত্যার স্বীকার। সন্দেহে সেনাসদস্যদের কেউ এ ঘটিয়ে থাকতে পারে।

প্রগতিশীল নাট্যকর্মী তনু ধর্ষণের পর হত্যার শিকার। সন্দেহে সেনাসদস্যদের কেউ এ ঘটিয়ে থাকতে পারে। ধর্মীয় কুসংস্কারের হিজাব পড়লেও ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই নেই।

ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর লাশ। ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় সারাদেশ বিক্ষুদ্ধ হয়। তনু একজন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মী ছিল। ধর্মীয় কুসংস্কারের হিজাব পড়লেও ধর্ষণের হাত থেকে সে রেহাই পেলনা।

সিপিএমএলএম বাংলাদেশ এর দলিলে দেখানো হয়েছে দুই ধরণের নারী নির্যাতন রয়েছেঃ সামন্ততান্ত্রিক আর বুর্জোয়া। সামন্ততন্ত্র নারীকে গৃহদাসী রূপে ঘরে আটকে রাখতে চায়, তাই তার উপর আরোপ করে অবরোধ। বুর্জোয়ারা নারীদের পন্যে রূপান্তরের প্রচেষ্টা চালায়। মধ্যশ্রেণীর অনেকে প্রথমটি বোঝে দ্বিতীয়টা বোঝেনা। বিভিন্ন সুবিধা প্রাপ্তির লোভে লালায়িত হয়। এরা লাঞ্চনা বঞ্চনা প্রাপ্ত হয়।

সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ পুরুষতান্ত্রিক যৌন ব্যবসা পরিচালনা করে, নারী পাচার

করে ও নারী নির্যাতন চালায়। সামন্ততন্ত্র ও পুঁজিতন্ত্রের মত এরাও নারীদের শত্রু।

নারীদের নিজেদের মুক্তির জন্য সাম্যবাদী ধারার নারী সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। যেমনটা সিপিএমএলএম বিবৃতিতে বলা হয়েছেঃ

এমন এক সাম্যবাদী সমাজের কথা কল্পনা করুন যেখানে কোন শোষণের চিহ্ন নেই, নারীরা আর যৌনদাসী নয়, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র নয় ।।