সিরাজ সিকদার রচনাঃ প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির ত্রয়োদশ ইশতেহার (ডিসেম্বর ১৯৭৪)

সিরাজ সিকদার রচনা

প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির
ত্রয়োদশ ইশতেহার

(ডিসেম্বর ১৯৭৪)

sikder

[আমরা বাংলায় প্রায় সমগ্র সিরাজ সিকদারের রচনা প্রকাশ করেছি। ইংরেজী অনুবাদও সম্পন্ন করেছি। অল্প কিছু বাকি ত্থাকতে পারে। আমাদের হাতে আসা মাত্রই তা প্রকাশ করব। বিগত এক বছর যাবত আমরা ‘সিরাজ সিকদারের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন’ আন্দোলন চালাচ্ছি। সংশোধনবাদীরা যা করে আমরা তার বিপরীত। সংশোধনবাদীরা সর্বহারা শ্রেণীর সম্পদ মার্কস, লেনিন, মাও, সিরাজ সিকদার, চারু মজুমদারের রচনাকে পুঁজিবাদী বাজারের কাছে বিক্রী করে দেয়। আমরা কমিউনিস্ট। আমরা সর্বহারা শ্রেণীর সম্পদকে পুনরুদ্ধার করি। আমরা ভয়ানক প্রতিকুলতার মধ্যে আমাদের কাজ করছি। আমেরিকা মহাদেশ থেকে ইউরোপ হয়ে এশিয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণীর অভূতপূর্ব নৈতিক সমর্থন আমরা এ কাজে পেয়েছি। সারা দুনিয়া জুড়ে কমরেডরা সিরাজ সিকদার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছেন, তার রচনাকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ ও প্রকাশ করছেন আর আমাদের অধ্যয়ন আন্দোলনের সাথে আছেন। এটা চমৎকার! অবশ্যই এটা সেবা করে বিশ্ববিপ্লবকে, আর আমাদের দেশের বিপ্লবকে, সামনের দিকে এগিয়ে যেতে। – সর্বহারা পথ]

১। হরতাল সংক্রান্তঃ

বাঙালী জাতি ও পূর্ববাংলার জনগনের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। ১৬ই ডিসেম্বর কালো দিবসে ভারতীয় বাহিনীর ঢাকা দখল এবং আওয়ামী পুতুল সরকার কায়েম এর জন্য দায়ী। আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উৎখাত করুন; দুর্ভিক্ষ-ক্ষুধার অবসান করুন; খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকুরী, বাসস্থানের ব্যবস্থা করুন; শান্তি, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র কায়েম করুন।
সিরাজ সিকদার, জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট, সর্বহারা পার্টি, সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর উপরোক্ত আহবানের ভিত্তিতে ১৫ ও ১৬ই ডিসেম্বর অর্ধদিবস হরতাল পালনের ডাক অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্যসম্পন্ন হয়েছে।
এ হরতালের আহবান বাস্তবায়িত করার জন্য সমগ্র পূর্ববাংলার ব্যাপক কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল, সমর্থক বিপুল উৎসাহের সাথে বিপদকে তুচ্ছ করে বিভিন্ন কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করেন।
এ হরতাল বাস্তবায়নের জন্য সমগ্র পূর্ববাংলায় শত্রুর উপর সার্বিক হামলা ও সমন্বিত আঘাত হানা হয় এবং শত্রুকে মারাত্মকভাবে ঘায়েল করা হয়।
বহু স্থানেই শত্রুর যোগাযোগ ব্যবস্থা বিকল করা হয়; শত্রুর প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়; শত্রুকে সর্বত্র হয়রানি করা হয়।
বহু জেলা, মহকুমা, থানা, শহর এবং হাট-বাজারে হরতাল পালিত হয়, পূর্ববাংলায় প্রায় সমগ্র পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ থাকে। হরতাল বাস্তবায়নের কার্যক্রমের এবং হরতালের সাফল্যে ব্যাপক কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল ও জনগণ অত্যন্ত আনন্দিত ও উৎসাহিত হন, বিপ্লবী জোশে তারা ফেটে পড়েছেন।
হরতালের ফলে বিরাট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে।
আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার লেজুড়সমূহ এবং তাদের প্রভুরা মারাত্মকভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত এবং নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। তারা নিজেদের কবরস্থ হওয়ার বিভীষিকা দেখছে।
অল্প কিছুদিনের মাঝেই আমাদের ধ্বংস করা হবে, “সিরাজ সিকদারসহ সবাই আমাদের হাতের মুঠায়”—শত্রুর এ সকল আস্ফালন সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
শত্রু আমাদের কর্মীদের গ্রেফতার, নির্যাতন ও হত্যা করে কর্মীদের মনোবল ভাঙ্গার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে—তাও ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে।
বিশেষ করে শত্রুর প্রচণ্ডতম চাপের স্থান ঢাকায় হরতাল সংক্রান্ত যে ব্যাপক তৎপরতা চালানো সম্ভব হয়েছে তা প্রমাণ করছে আমাদের সংগঠনের ব্যাপক কর্মীরা খুবই সক্রিয়, উৎসাহী ও কর্মক্ষম।
১৫ই ও ১৬ই ডিসেম্বর হরতাল আমাদের একটি বিরাট বিজয়।
* এ হরতালের সফলতা জনগণের নিকট প্রমাণ করছে—
আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের উৎখাত করা এবং জনগণের মুক্তি আনা একমাত্র সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বেই সম্ভব।
* হরতাল প্রমাণ করছে, সশস্ত্র ও গণসংগ্রামের সমন্বয়ের নীতি পূর্ববাংলার সর্বহারার পার্টির একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পন্ন সিদ্ধান্ত। পার্টির নেতৃত্বে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা, বিপ্লব ও পার্টির পক্ষে জনমত সৃষ্টি করার (যা বিপ্লবের জন্য প্রথম প্রয়োজন) ক্ষেত্রে গণসংগ্রাম অত্যন্ত উপযোগী।
পূর্ববাংলার বাস্তব অবস্থার (ক্ষুদ্র দেশ, ঘনবসতি, ভাষাগত-সাংস্কৃতিক অভিন্নতা, অর্থনৈতিক সমবিকাশ ইত্যাদি) সাথে এ গণসংগ্রামের লাইন খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
* এ হরতালে আমাদের খুবই সামান্য ক্ষতি হয়েছে। এ থেকে দেখা যায় যথাযথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা পালন করলে প্রচণ্ড চাপের মুখেও ক্ষতি এড়ানো সম্ভব।
* এ হরতালের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়—
নিম্নস্তরের অবমূল্যায়ন করা হয়।
সবকিছু একজনে করা, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির কারণে নিম্নস্তরের উদোগ ব্যহত হয়।
নিম্নস্তরের উদ্যোগকে জাগাতে হবে। উদ্যোগকে কাজে লাগাতে হবে। তাদেরকে গাইড-লাইনের ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। সাহসিকতার সাথে তাদেরকে ব্যবহার করতে হবে।
এভাবে ব্যাপক কর্মীদের কাজে লাগানো, পরীক্ষা-যাচাই এবং কর্মীর স্বল্পতা, কাজের স্বল্পতা এড়ানো যায়।
* গোপনে থেকেও গণসংগ্রাম পরিচালনার সফলতা জাসদ, ভাসানী ন্যাপ, জাফর-মেনন-হালিমদের পিপলস পার্টি ইত্যাদির অস্তিত্ব অপ্রয়োজনীয় বলে প্রমাণ করেছে।
* এ হরতালের সফলতা হক-তোয়াহা, মতিনদের কর্মী, সহানুভূতিশীল, সমর্থক এবং অন্যান্য বামপন্থীদেরকে আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে উদ্ধুদ্ধ করবে।
* এ হরতালের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করছে, শহর এলাকায় সাফল্যজনক হরতাল বা এ ধরণের গণসংগ্রামের জন্য শহরের প্রতি পাড়া, শিল্প, শিক্ষা, সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ, শহরেরে বাইরেরে অঞ্চলে সশস্ত্র সংগ্রাম, জেলার সংলগ্ন অন্য জেলায় সশস্ত্র কাজ প্রয়োজন।
হরতালের কয়েকদিন পূর্ব থেকেই বিভিন্ন উপায়ে (সশস্ত্র মিছিল, পোস্টার, লিফলেট, দেওয়াল লিখন ও অন্যান্য) ব্যাপক প্রচার ও সশস্ত্র তৎপরতা প্রয়োজন। এমন কি হরতালের দিনও হরতাল বাস্তবায়নের জন্য সশস্ত্র তৎপরতা প্রয়োজন।
* হরতালের বিরাট সাফল্যে মাথা বিগড়ালে চলবে না। শত্রুর প্রচণ্ড চাপের মুখে কঠোর সতর্কতা বজায় রাখতে হবে। কর্মী, গেরিলা বিশেষ করে নেতৃস্থানীয় কর্মীদের রক্ষা করতে হবে।
হরতালের ফলে সৃষ্ট জনসমর্থন ও জোয়ারকে ধরে রাখার জন্য ব্যাপক জনগণকে সংগঠিত করতে হবে। ব্যাপক কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল, সমর্থক সংগ্রহ করতে হবে।
সংগঠনের সাধারণ লক্ষ্যসমূহ দ্রুত বাস্তবায়িত করতে হবে।

২। হরতালের পরবর্তী লক্ষ্যঃ

ক) আন্তঃঅঞ্চল, আন্তঃউপঅঞ্চল, আন্তঃএলাকার নিয়োগ-বদলী দ্রুত সম্পন্ন করা।
খ) যে সকল অঞ্চলে মানোন্নয়ন সংক্রান্ত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি, সে সকল অঞ্চল এ কাজকে অগ্রাধিকার দেবে এবং মানোন্নয়ন দ্রুত সম্পন্ন করবে।
শিক্ষা শিবির স্থাপন, ব্যাচে ব্যাচে কেডারদের মানোন্নয়ন করতে হবে।
এ সময় কেডার ইতিহাস সংগ্রহ ও যাচাই করতে হবে এবং উচ্চস্তরে পাঠাতে হবে।
সদস্য/প্রার্থীসদস্য পদের জন্য যারা আবেদন করেছে তাদের তালিকা, যারা আবেদন করতে ইচ্ছুক তাদের আবেদনপত্র পাঠাতে হবে।
গ) শত্রুর চাপে এলাকা বা অঞ্চলে বিপর্যয় সংগঠিত হয়—কেডার, গেরিলা, অস্ত্র, গুরুত্বপূর্ণ সহানুভূতিশীল হারানো বা লস ঠেকাতে হবে তাদের প্রত্যাহারের মাধ্যমে।
প্রধানতঃ কেডার হারানোই অন্যতম বিপর্যয়। এদের মাধ্যমেই নিম্নস্তর, গেরিলা, কর্মী, সহানুভূতিশীল ও সমর্থক এবং জনগণের সাথে সংযোগ বজায় থাকে—পার্টির লাইন বাস্তবায়িত হয়।
এদের হারানোর সংখ্যা এ কারণেই বেশী।
এ কারণে এদেরকে গোপনীয়তা, নিরাপত্তা, সতর্কতা এবং কর্মপদ্ধতির উপর ভাল ট্রেনিং দিতে হবে যাতে লস কম হয়।
উপরন্তু ব্যাপক সংখ্যায় এ ধরনের কেডার—এলাকা পরিচালক—গেরিলা পরিচালক গড়ে তোলা উচিত।
এজন্য শুধু এ ধরনের কেডার তৈরীর জন্য বিশেষ মানোন্নয়ন ও ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা এবং প্রতি অঞ্চলে রিজার্ভ গড়ে তোলা এবং মাঝারী, অনুন্নত অঞ্চলে প্রেরণ করতে হবে।
পার্টি ও সেনাবাহিনীতে এ ধরনের রিক্রুটমেন্ট হচ্ছে সেনাবাহিনীর ‘অফিসার’ রিক্রুটমেন্টের অনুরূপ।
একটি সেনাবাহিনীতে ভাল অফিসার প্রয়োজন উত্তম পরিচালনার জন্য। বর্তমানে আমাদের ব্যাপক কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল ও সমর্থক রয়েছে। তাদের নেতৃত্ব প্রদান ও পরিচালনার জন্য ‘কেডার’ অর্থাৎ অফিসার র‍্যাংকে ব্যাপক কর্মী সংগ্রহ, ট্রেনিং-বাছাই-নিয়োগ প্রয়োজন।
এ কারণে সরাসরি এলাকা পরিচালক, উপ-এলাকা পরিচালক, গেরিলা পরিচালকের জন্য কেডার ইতিহাসসহ আবেদেনপত্র আহবান করতে হবে (সার্বক্ষণিক-অসার্বক্ষণিক নির্বিশেষে)।
কেডার ইতিহাস যাচাই-এর ভিত্তিতে আবেদনকারীদের আবেদন মঞ্জুর করে ট্রেনিং ও মানোন্নয়ন করতে হবে।

ট্রেনিং-মানোন্নয়ন নিম্ন বিষয়ে হবেঃ

একজন এলাকা, উপ-এলাকা এবং গেরিলা পরিচালকের কাজ, সংগঠনের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক, মতাদর্শগত বিষয়।
পাঠ্যসূচী এবং সংগঠন প্রকাশিত সামরিক, সাংগঠনিক, চক্র বিরোধী দলিল, ইশতেহার এবং অন্যান্য দলিল ও মার্কসবাদী পুস্তকের ভিত্তিতে মানোন্নয়ন করতে হবে।
মানোন্নয়ন ও ট্রেনিং-এর ভিত্তিতে কেডারদের কাজে লাগাতে হবে এবং তাদের যাচাই করতে হবে।
এভাবে কর্মীস্বল্পতা দূর করতে হবে।
ঘ) আমাদের অঞ্চলসমূহকে অগ্রসর, মাঝারি ও পশ্চাদপদ এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
পশ্চাদপদদের দায়িত্ব হচ্ছে মাঝারী বা অগ্রসরদের সমকক্ষতা অর্জন করা।
মাঝারীদের দায়িত্ব হচ্ছে অগ্রসরদের ধরা বা তাদের ছাড়িয়ে যাওয়া।
অগ্রসরদের দায়িত্ব হচ্ছে আরো অগ্রসর হওয়া।

অগ্রসরদের দায়িত্ব হচ্ছেঃ

অঞ্চল, এলাকা, অন্য অঞ্চলের মধ্যকার ফাঁকসমূহ দূর করা, গ্রামভিত্তিক কাজ বিকাশ করা, ব্যাপক গ্রাম জাতীয় শত্রু মুক্ত করা, গ্রাম পরিচালনা কমিট গঠন করা, গ্রামভিত্তিক চাঁদা সংগ্রহ করা, টাউট-জাতীয় শত্রুদের আত্মসমর্পণ করানো, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা বজায় রাখা এবং উচ্চস্তরকে অধিকতর সাহায্য করা ও প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বিভিন্ন উপদলবাদীদের সমস্যার সমাধান করা, অন্তর্ঘাতক ও অনুপ্রবেশকারীদের নির্মূল করা, অস্ত্রাদি রক্ষা ও ঠিকঠাক রাখা, প্রতি উপ অঞ্চল, এলাকা, উপ-এলাকাকে জাতীয় শত্রু খতমে স্বাবলম্বী করে তোলা, শিক্ষা শিবির চালু করা, এলাকা, উপ-এলাকা, গেরিলা পরিচালকদের রিজার্ভ গড়ে তোলা এবং অনুন্নত ও মাঝারী অঞ্চলে প্রেরণঃ মানোন্নয়ন ও ট্রেনিং সম্পন্ন করা; আঞ্চলিক ও স্থানীয় নিয়মিত বাহিনী গড়ে তোলা; গণসংগ্রাম চালানো; সশস্ত্র ও নিরস্ত্র প্রচার টিম এবং অন্যান্য প্রচার তৎপরতা জোরদার করা, আঞ্চলিক নেতৃত্ব গ্রুপ গঠন করা।

মাঝারী অঞ্চলসমূহ নিম্নলিখিত কাজ করবেঃ

জাতীয় শত্রু খতম করা, সশস্ত্র প্রচার টিম ও অন্যান্য উপায়ে ব্যাপক প্রচার চালানো, টাউট ও জাতীয় শত্রুদের আত্মসমর্পণ, গ্রাম ভিত্তিক চাঁদা সংগ্রহ, কর্মী-সহানুভূতিশীলদের চাঁদা নিয়মিতকরণ, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন, শিক্ষা শিবির পরিচালনার মাধ্যমে মানোন্নয়ন করা, একাধিক বিশেষ এলাকা আঁকড়ে ধরে কাজকে দ্রুত উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, গ্যাপসমূহ পূরণ, কাজের সফলতা আনা, বিপর্যয় এড়ানো, উন্নত অঞ্চলের সমকক্ষতা অর্জন বা তাকে ছাড়িয়ে যাওয়া।

পশ্চাদপদ অঞ্চলে সকল সংযোগ স্থাপন ও উদ্ধার, সক্রিয় কর্মীদের মানোন্নয়ন, এভাবে সার্বক্ষণিক বাড়ানো; অন্য অঞ্চল থেকে কর্মী এনে নিয়োগ; ব্যাপক পোস্টার, লিফলেট, দেওয়াল লিখন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচার করা। শেল্টার গড়ে তোলা, একটা বিশেষ এলাকা গড়ে তোলা, সশস্ত্র প্রচার, জাতীয় শত্রু খতমের পদক্ষেপ নেওয়া, এভাবে ক্রমাগত বিশেষ এলাকা গঠন ও কাজ বিকাশ করা, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন, বিপর্যয় এড়ানো, মাঝারী অঞ্চলের মান অর্জনের চেষ্টা করবে।
ঙ) একটি অঞ্চলে এক বা একাধিক বিশেষ এলাকা আঁকড়ে ধরে দ্রুত কাজের বিকাশ ঘটাতে হবে।
ভাল কাজ, শেল্টার আছে, কর্মী জিনিস একত্র করা সম্ভব, বিস্তৃতি রয়েছে এরূপ এলাকাকে বিশেষ এলাকা হিসেবে আঁকড়ে ধরা যায়।
বিশেষ এলাকায় কর্মী, গেরিলা সমাবেশ করা, বিশেষ এলাকাকে কেন্দ্র করে পার্শ্ববর্তী স্থানসমূহে অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ব্যাপক লাইন দেওয়া, সশস্ত্র প্রচার চালানো, জাতীয় শত্রু খতম করা, জাতীয় শত্রু-টাউট আত্মসমর্পণ করানো ইত্যাদি তৎপরতা চালানো।
এভাবে কাজের বিকাশ করা।
এ বিকাশ হওয়া উচিত কাজের গ্যাপ পূরণের লক্ষ্য সামনে রেখে।
আক্রমণের স্থল, আশ্রয়স্থল ইত্যাদি বিবেচনা করা কাজ করা উচিত যাতে নিরাপত্তা বজায় থাকে।
এ বিশেষ এলাকা সংক্রান্ত কাজের মাধ্যমে কর্মীদের বাস্তব ট্রেনিং-এর জন্য অন্য এলাকা, উপ-অঞ্চল থেকে কর্মী সমাবেশ করা।
বাস্তব ট্রেনিং-এর সাথে মানোন্নয়ন চালানো। এভাবে বিশেষ এলাকা গঠন করে কাজে সফলতা আনয়ন ও বিকাশ সাধন করা।
চ) প্রতি অঞ্চলে আঞ্চলিক পরিচালককে সম্পাদক করে তিন বা পাঁচ বা ততোধিক বেজোড় সংখ্যক সদস্য নিয়ে একটি আঞ্চলিক নেতৃত্ব গ্রুপ গড়ে তোলা।
যেখানে বাস্তব অবস্থা বিরাজ করে এবং পরীক্ষিত কর্মী রয়েছে সেখানেই ইহা প্রযোজ্য।
উপ-অঞ্চল, এলাকা, সম্ভব হলে উপ-এলাকা ভিত্তিক নেতৃত্ব গ্রুপ গড়ে তোলা।
নেতৃস্থানীয় কর্মীদের বৈঠকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এ নেতৃত্ব গ্রুপ গঠন করা। ইহা উচ্চস্তরের অনুমোদনের জন্য পেশ করা।
এ নেতৃত্ব গ্রুপ গঠন করার পর প্রতি স্তর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব গ্রুপের বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। নেতৃত্ব গ্রুপের বৈঠকের বাইরে সম্পাদক প্রদত্ত সিদ্ধান্ত নেতৃত্ব গ্রুপের বৈঠকে অনুমোদন করিয়ে নিতে পারে।
এ সকল সিদ্ধান্ত উচ্চস্তরে রিপোর্ট করতে হবে।
ছ) একটি এলাকার কাজের সূচনা, বিকাশ, শত্রুর চাপ, বিপর্যয়, কাজ পুনরুদ্ধার, বিকাশ, পুনরায় শত্রুর চাপ, বিপর্যয়-কাজ-পুনরুদ্ধার, বিকাশ এই সাইকেলে এগিয়ে চলে।
কাজেই শত্রুর চাপ-বিপর্যয় বিপ্লবে স্বাভাবিক, আবার কাজ পুনরুদ্ধার-বিকাশও স্বাভাবিক। এভাবেই শেষ পর্যন্ত শত্রুকে পরাজিত ও ধ্বংস করা সম্ভব।
এছাড়া দেখা যায় কোন অঞ্চলে বিকাশ আবার অন্য অঞ্চলে বিপর্যয়, অঞ্চলের মাঝে কোন এলাকায় বিকাশ আবার কোন এলাকায় বিপর্যয় এভাবে কাজ অগ্রসর হয়।
বিপ্লবের এই আঁকাবাঁকা, উত্থান-পতন, বিপর্যয়-বিকাশ অর্থাৎ আমাদের মত দেশে বিপ্লবের এই অসম বিকাশের (Uneven Development) নিয়ম অনুযায়ী আমাদের চিন্তা ও কর্মকে পরিচালিত করতে হবে।

৩। শত্রুর শীতকালীন রণনৈতিক আক্রমণ প্রসঙ্গেঃ

শত্রু শীতকালীন রণনৈতিক আক্রমণ শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই শত্রু তার চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী কম্বিং এবং শ্বেতসন্ত্রাস শুরু করেছে। মুন্সিগঞ্জে শত্রু আমাদের কর্মী, সহানুভূতিশীলদের নির্মমভাবে হত্যা করে গ্রামের রাস্তায় ফেলে রেখেছে। তারা শত শত জনগণকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করছে।
অন্যান্য অঞ্চলেও তারা একই তৎপরতা চালাচ্ছে বা চালাবার চেষ্টা করছে।
শত্রুর শীতকালীন হামলার মুখে রণনৈতিক আত্মরক্ষার লাইন গ্রহণ করতে হবে।
* অস্ত্র-কর্মী-গেরিলা রক্ষা করতে হবে।
* আভ্যন্তরীণ অন্তর্ঘাতক, অনুপ্রবেশকারী শত্রুচর, সুবিধাবাদী, দোদুল্যমানদের বিচ্ছিন্ন করতে হবে। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
* ব্যাপক মানোন্নয়ন ও ট্রেনিং সম্পন্ন করতে হবে।
* কাজের বিস্তৃতি বাড়াতে হবে। গ্যাপসমূহ পূরণ করতে হবে।
* বিশেষ এলাকা, আক্রমণ এলাকা, পশ্চাদপদ এলাকা নির্ধারণ করে কাজকে দ্রুত এগিয়ে নিতে হবে।
* ব্যাপক প্রচার জোরদার করতে হবে।
* গণসংগ্রাম জোরদার করতে হবে।
* শত্রুর ছোট ছোট ইউনিটকে এম্বুশ করতে হবে। বিচ্ছিন্ন থানা, ফাঁড়ি দখল করতে হবে। শত্রুর দৃষ্টি সরানোর জন্য হামলা চালাতে হবে।
* জনগণের নিকটস্থ আগ্নেয়াস্ত্র জমা নিতে হবে।
* শহর এলাকায়, যোগাযোগ পথে, শত্রুর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে, অর্থনৈতিক ও প্রশাসন প্রতিষ্ঠানে হামলা চালাতে হবে। এ সকল স্থানে শত্রুকে আটকে ফেলতে হবে।
* শত্রুর চাপ মাঝারী ও পশ্চাদপদ অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে হবে। এভাবে শত্রুশক্তিকে বিভক্ত করতে হবে।
* শত্রুর শীতকালীন আক্রমণকে ব্যর্থ করে দিতে হবে। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি যাতে সর্বনিম্ন হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের লক্ষ্যসমূহ অর্জনে দৃঢ়ভাবে কাজ করতে হবে।

সর্বহারা শ্রেণীর সঠিক রাজনৈতিক পার্টির উপস্থিতি শত্রু-শিবিরে এবং সংশোধনবাদী, নয়া সংশোধনবাদী, সুবিধাবাদীদের মাঝে সংঘাত, ভাঙন, পুনর্গঠন, পুনরায় ভাঙনের সৃষ্টি করে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের পতন ডেকে আনে।
সম্প্রতি মনি-মোজাফফর সংশোধনবাদীদের মাঝে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। মতি-আলাউদ্দিনরা একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। হক-তোয়াহাদের মাঝেও অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছে।
আওয়ামী লীগের মাঝে এবং আওয়ামী লীগের সাথে তার অঙ্গদলের দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়েছে।
কাজী জাফর-মেনন তাদের অপকর্মের জন্য ন্যাপ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে।
হক-তোয়াহা, মতিন যারা একে অপরকে সংশোধনবাদী প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে গালাগালি করেছে, একে অপরকে বহিষ্কার করেছে, তারা নিজেদেরকে রক্ষার জন্য পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে।
কাজী-মেনন-মোজাফফর ন্যাপের হালিম মিলে জ্যোতি বসু মার্কা দল তোরী করছে।
এইভাবে সর্বহারা পার্টির উপস্থিতি বিভিন্ন ভাঙন-পুনর্গঠন-ভাঙন-পতনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে।

আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকরা আমাদের উপর সর্বাত্মক চাপ দিচ্ছে।
তারা আমাদেরকে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে। আমাদেরকে দাবিয়ে রাখতে পারলে তারা নির্বিবাদে বহু বছর শোষণ লুন্ঠন চালাতে পারবে বলে চিন্তা করে।
প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল জাসদ হচ্ছে ভারত-মার্কিনের দালাল এবং আওয়ামী লীগের সাথে গোপন আঁতাতযুক্ত, বিপ্লবীদের বিপথগামী, নিষ্ক্রিয় ও নির্মূল করার ফাঁদ। কাজেই আওয়ামী লীগ জাসদ থেকে নিরাপদ।
ভাসানী ন্যাপ-আতাউর রহমান দ্বারা আওয়ামী লীগ উৎখাত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
কাজী জাফর-মেনন-ক্যাপ্টেন হালিম ভারতের জ্যোতিবসু-নাম্বুদ্রিপদকে অনুসরণ করে আওয়ামী লীগের সাথে লাইন রেখে চলছে। কাজেই এদের দ্বারা আওয়ামী লীগের ভয় নেই।
হক-তোয়াহা, মতিনদের সংশোধনবাদী নেতৃত্ব প্রতিনিয়ত ভুল লাইন অনুসরণ করার ফলে অন্তঃর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত। বারংবার বিভক্ত এবং জনগণের আস্থাহীন। এদের থেকে আওয়ামী লীগের ভয় নেই।
কাজেই আওয়ামী লীগের সত্যিকার প্রতিদ্বন্দ্বী আমরা ব্যতীত আর কেউ নেই। এ কারণে আওয়ামী লীগ তার সকল চাপ আমাদের উপর কেন্দ্রীভূত করেছে।
এ কারণে আমাদের সতর্কতা বাড়াতে হবে। শত্রুর চাপের মুখেও টিকে থাকতে ও বিকাশ লাভ করতে হবে এবং আসন্ন ঝড়ের নেতৃত্ব দিতে হবে।
অসতর্ক, শত্রুদের এড়াতে সক্ষম নয়, পুরোনো পরিস্থিতির উপযোগী, পুরোনো কর্মপদ্ধতি একগুঁয়েভাবে অনুসরণ করে এ ধরণের কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ বিপজ্জনক এলাকা থেকে সরিয়ে দিতে হবে বা বসিয়ে রাখতে হবে।

হক-তোয়াহা-মতিনদের উপদলীয় অস্তিত্ব পূর্ববাংলার বিপ্লবী প্রয়োজনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তাদের অস্তিত্ব সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণকে বিভক্ত করে, তাদের অনুসৃত ভুল লাইন আন্তরিকভাবে বিপ্লবী কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল ও জনগণকে বিপথগামী-প্রতারিত করে। তাদের আত্মত্যাগকে অর্থহীন করে। এ সকল উপদলের ছত্রছায়ায় শত্রুচর, টাউট, ডাকাত, সুবিধাবাদীরা জনগণের উপর নির্যাতন করে, সর্বহারা পার্টির বিরুদ্ধে এক হাজার একটা কুৎসা রটনা করে, কর্মীদের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক পদক্ষেপ নেয়।
আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক, মনি-মোজাফফর, পাহাড়ী সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীসহ দেশী-বিদেশী সকল প্রতিক্রিয়াশীলরা এ সকল উপদলের অস্তিত্বের উল্লেখ করে জনগণ বিপ্লবীদের হতাশ করা এবং নিজেদের টিকে থাকার যৌক্তিকতা দেখায়।
এ সকল উপদলের সাথে যুক্ত আন্তরিকভাবে সর্বহারা বিপ্লবীদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এ সকল উপদলের ছত্রছায়ায় কর্মরত ডাকাত, টাউট, শত্রুচর এবং পরিকল্পিতভাবে অসৎ উদ্দেশ্যে সর্বহারা পার্টির বিরুদ্ধে অপপ্রচার-কুৎসা রটনাকারী এরূপ সক্রিয় প্রতিক্রিয়াশীলদের মুখোশ উন্মোচন, তাদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি এবং যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

সম্প্রতি জাসদ, কাজী জাফর-মেনন ইত্যাদিরা বর্তমান সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য সর্বদলীয় সরকার কায়েমের কথা বলছে।
তাদের এ প্রস্তাব জনগণের কোন উপকারে আসবে না, ইহা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের স্বার্থ রক্ষাকারী প্রস্তাব।
পূর্ববাংলার জনগণের এ চরমতম সংকটজনক অবস্থার জন্য দায়ী ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের নিষ্ঠুরতম শোষণ ও লুন্ঠন। কাজেই জনগণকে এ সংকট থেকে উদ্ধারের উপায় হলো—
আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, একই সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করা, পূর্ববাংলার সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক এবং দেশপ্রেমিক নাগরিকদের জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করা।
এ জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার হবে গণতান্ত্রিক একনায়কত্বমূলক—জনগণের জন্য গণতন্ত্র এবং শত্রুদের উপর একনায়ত্ব।
পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের কর্মসূচী, ১৫ই ১৬ই ডিসেম্বর হরতাল পালনের আহবানে প্রদত্ত কর্মসূচীতে এ সংকট থেকে উদ্ধারের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী প্রদান করা হয়েছে।
উপরোক্ত কর্মসূচী বাস্তবায়ন এবং এভাবে জনগণকে সংকট থেকে উদ্ধার ও বাঁচানো সম্ভব হবে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের উৎখাত করে।
কাজেই জাসদ, কাজী জাফর এবং অন্যান্যদের বক্তব্য সর্বদলীয় সরকার (মনি, মোজাফফর, আওয়ামী লীগ প্রভৃতি প্রত্যক্ষ ভারতীয় দালালসহ) কায়েমের প্রস্তাব প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় শোষণ ও লুন্ঠন বজায় রাখা, আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক, মনি-মোজাফফরদের সাথে মিলে শোষণ-লুন্ঠনের বখরা নেওয়া, হালুয়া-রুটির ভাগ পাওয়া।

পরিশিষ্ট ১
মনি-মোজাফফর ভাঙ্গন প্রসঙ্গে

মনি সিং-মোজাফফরদের নিয়ন্ত্রিত তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যকার সাম্প্রতিক ভাঙ্গন সংশোধনবাদী রাজনীতির চরমতম দেউলিয়াত্বের পরিণতি।
মনি সিং-মোজাফফর মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সাথে পুরোপুরি বিশ্বাসঘাতকতা করে। ছোট-বড় নির্বিশেষে দেশীয়-আন্তর্জাতিক প্রশ্নে আওয়ামী লীগ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নির্লজ্জ দালালীর লাইন গ্রহণ করে এবং দেশ, জাতি ও জনগণের স্বাধীনতা, বিপ্লব, মুক্তি বিরোধী চরমতম প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করে।
তাদের এহেন বিশ্বাসঘাতক কার্যকলাপের ফলে ব্যাপক কর্মী, সহানুভূতিশীল, সমর্থক তাদের পরিত্যাগ করে বা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
ক্যাপ্টেন হালিম এবং অন্যান্যদের বিদ্রোহ এরূপ একটি ঘটনা। ক্যাপ্টেন হালিমের বক্তব্য ও কার্যকলাপ, শেষ পর্যন্ত কাজী-জাফর-মেনন চক্রের সাথে যোগদান প্রমাণ করে তারা মতাদর্শের ভিত্তিতে রাজনৈতিকভাবে বিদ্রোহ করেনি, তারা এখনও অন্য আকৃতিতে মনি-মোজাফফরদের বিশ্বাসঘাতক রাজনীতি ও মতাদর্শ অনুসরণ করছে।
তাদের বিভক্তি হচ্ছে সাংগঠনিক বিভক্তি অর্থাৎ আলাদা হয়ে পৃথক সংগঠনে যোগদান, মতাদর্শগত-রাজনৈতিক বিভক্তি নয়।
ক্যাপ্টেন হালিম মনি-মোজাফফরদের মত শান্তিপূর্ণ পার্লামেন্টারী উপায়ে সরকারের উৎখাত চান। শান্তিপূর্ণ উপায়ে পার্লামেন্টারী নির্বাচনের মাধ্যমে কখনো বুর্জোয়াদের উৎখাত করা যায় না, বরঞ্চ পার্লেমেন্টারী নির্বাচনের কথা বলে জনগণকে পার্লামেন্টারী নির্বাচনের কানাগলি পথে আটকে রাখা হয়। এটা বুর্জোয়াদের জন্য সুবিধাজনক—এ কারণেই বুর্জোয়ারা এটা অনুমোদন করে।
এভাবে কাজী চক্রের সাথে গলা মিলিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা দখলের কথা বলে তিনি প্রমান করেছেন তিনি এখনও সংশোধনবাদী লাইন অনুসরণ করছেন।
তিনি আওয়ামী লীগকে বিরোধিতা করেন বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু কাজী চক্র প্রকাশ্যে (সম্প্রতি কাজীচক্র শেখ মনির সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করে) এবং গোপনে আওয়ামী লীগের সাথে সংযুক্ত (বামপন্থীদের ও জনগণকে ধোকা দেওয়ার জন্য)। ভারতের কংগ্রেসের সাথে সিপিএম-এর যেরূপ প্রকাশ্য ও গোপন সম্পর্ক রয়েছে, কাজী-মেননদের আওয়ামী লীগের সাথে অনুরূপ সম্পর্ক রয়েছে। কাজেই তাদের সাথে যুক্ত হয়ে তিনি কীভাবে আওয়ামী বিরোধী হন? তিনি চীনের সমর্থক বলে উল্লেখ করেন, অথচ কাজীচক্র কট্রর চীনবিরোধী এবং প্রকাশ্যে চীনকে নিন্দা ও বিরোধিতা করেছে।
প্রকৃতপক্ষে কাজী চক্র হচ্ছে আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রাখার একটি প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠান যার উদ্দেশ্য বামপন্থী ও জনগণকে প্রতারণা করা। ভারতে কংগ্রেস জ্যোতিবসু ও নাম্বুদ্রিপদের সিপিএম-কে এভাবেই টিকিয়ে রেখেছে।
উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় কাজী চক্রের সাথে যোগদান করে ক্যাপ্টেন হালিম প্রমাণ করেন তিনি সংশোধনবাদী রাজনীতি ভিন্ন আকৃতিতে অনুসরণ করেছেন। আপাতঃদৃষ্টিতে তা ভারত, সোভিয়েট ও আওয়ামী বিরোধী হলেও চূড়ান্ত বিশ্লেষনে তা আওয়ামী লীগ, ভারত ও সোভিয়েট স্বার্থ রক্ষাকারী।
এদের প্রতারণার ফানুস অদূর ভবিষ্যতেই ফেটে পড়বে এবং সাচ্চা কর্মী ও জনগণ তাদেরকে বস্তাপচা মাল হিসেবে ইতিহাসের ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করবে।
সুবিধাবাদ ও সংশোধনবাদের ভিত্তিতে কাজী চক্রের সাথে হালিমদের সাংগঠনিক ঐক্য অদূর ভবিষ্যতে ভেঙ্গে পড়বে। পরস্পরের অন্তর্দ্বন্দ্বে তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
মনি-মোজাফফরদের এ ভাঙ্গন, কর্মীদের বিদ্রোহ তাদের মরণঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছে। অদূর ভবিষ্যতেই গুটিকতক দালাল ব্যতীত তাদের সাথে আর কেহ থাকবে না।

পরিশিষ্ট ২

প্রকাশ্য সংগঠনসমূহের ঐক্য তৎপরতা

বাঙালী জাতি ও পূর্ববাংলার জনগণের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। জনগণ অনতিবিলম্বে আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের উৎখাত চান। এবং অন্ন, বস্ত্র, চাকুরী, বাসস্থান, শিক্ষা, শান্তি, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র চান, তারা মানুষের মত বাঁচতে চান।
জনগণের এ চরমতম সংকটজনক সময়ে যার সামান্যতম সচেতনতা ও দেশপ্রেম রয়েছে তিনিই চাইবেন আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের উৎখাতের জন্যও দল-মত নির্বিশেষে প্রকাশ্য ও গোপনে কর্মরত, শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র সংগ্রামরত সকল দেশপ্রেমিকদের ঐক্য।
দেশপ্রেমিকদের এ ঐক্যের নিম্নতম ভিত্তি হচ্ছে আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের ও তার প্রভুদের উৎখাত এবং জনগণের অন্ন, বস্ত্র, চাকুরী, বাসস্থানের ব্যবস্থা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, শান্তি কায়েমের মত মৌলিক বিষয় সম্বলিত ব্যাপক কর্মসূচী।
উপরন্তু ঐক্য হবে দেশপ্রেমিক শক্তিসমূহের মধ্যে যারা আন্তরিকভাবে উপরোক্ত কর্মসূচী কায়েমের জন্য কাজ করে যেতে ইচ্ছুক।
পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট, সর্বহারা পার্টি ও সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী উপরোক্ত নীতির ভিত্তিতে দেশপ্রেমিক শক্তিসমূহের ঐক্যের জন্য বারংবার আহবান জানিয়ে এসেছে এবং কাজ করে যাচ্ছে। দেশপ্রেমিক শক্তিসমূহের উপরোক্ত ভিত্তিতে সকল প্রকার প্রচেষ্টা গ্রহণকে স্বাগত জানায়।
কিন্তু সম্প্রতি দেখা যায় জাতীয় মুক্তি ও গণতন্ত্র কায়েম, অন্ন, বস্ত্র, চাকুরী, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদির সুনির্দিষ্ট ও ব্যাপক কর্মসূচী ব্যতিরেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্রুপসমূহ তথাকথিত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রচেষ্টা, পুরনো দল ভেঙে দিয়ে নতুন দল গঠন ইত্যাদি তৎপরতা চালাচ্ছে।
এ ধরনের তৎপরতায় দেশপেমিক আর দেশদ্রোহী, প্রকাশ্য বা গোপন শত্রুচর, বিপ্লবী বা সুবিধাবাদী ইত্যাদির মধ্য কোন পার্থক্য করা হচ্ছে না। এমন কি সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছে এরূপ শক্তিসমূহকেও ঐক্য প্রচেষ্টা থেকে দূরে রাখার ষড়যন্ত্র চলছে।
তাদের প্রচেষ্টা দেখে মনে হয়ে তড়িঘড়ি একটা ঐক্য দাঁড়া করে জনগণকে ধোঁকা দেয়া এবং যেনতেন ঐক্য করেই ক্ষমতা দখল করা ও হালুয়া-রুটি লুট করে ভাগ বাটোয়ারা করা।
এ সকল ঐক্য-উদ্যোক্তারা পূর্ববাংলার বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। তারা উপলব্ধি করছেনা ১৯৬৯-এর পূর্বের অবস্থা যখন আট-নেতা নয়-নেতার বিবৃতি, ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন ইত্যাদির মাধ্যমেই ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে।
বর্তমানে তথাকথিত নেতাদের প্রতি জনগণের আস্থা নেই, ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করার মত ছাত্র সংগঠন নেই। ১৯৭১-এ গণ আন্দোলন গড়ে তোলার মত সংগঠন আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগ ও শ্রমিক লীগ ছিল। সে ধরণের সংগঠন বর্তমানে কারো নেই। উপরন্তু আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টরা তাদের ফ্যাসিস্ট বাহিনী দ্বারা জনগণকে দাবিয়ে রাখার জন্য সর্বদাই সচেষ্ট।
অন্যদিকে পূর্ববাংলার ব্যাপক গ্রামাঞ্চলে ও শহরে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি অন্যতম সংগঠিত শক্তি হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে। কাজেই কোন গণ আন্দোলন সর্বহারা পার্টি ব্যতিরেকে গড়ে তোলা সম্ভব হয়ে উঠবে না।
যে সকল শক্তি ঐক্যের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তাদের অনেকেই প্রকাশ্যে-গোপনে আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাথে যুক্ত। এরা … ঐক্য গড়ে তুলবে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণ ও দেশপ্রেমিকদের ভাওতা দেয়া, আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের টিকিয়ে রাখা। উপরন্তু ভারতকে হটিয়ে দিয়ে মার্কিনকে বসাতে চায় এরূপ শক্তিও ঐক্যের প্রচেষ্টা করছে।
কাজেই সত্যিকার দেশপ্রেমিকদের ঐক্য নয়, জনগণকে বিভ্রান্ত করার মত বিভিন্ন শক্তি যারা দেশীয়-আন্তর্জাতিক শোষকের সাথে যুক্ত তারা তথাকথিত ঐক্যের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
জাসদ ঐক্যের কথা বলে ঐক্যের প্রচেষ্টাকে বানচাল করার জন্য একলা চলার নীতি অনুসরণ করছে। অতীতেও সে একই ধরণের কাজ করেছে। এভাবে সে নিজেকে ঐক্য-বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলদের স্বার্থরক্ষাকারী শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছে।
এ সকল প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য শত্রুচর এবং বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের তথাকথিত ঐক্য জনগণের কোন উপকারেই আসবে না। উপরন্তু এ ধরণের ঐক্য ব্যাপকতর ভাঙনের জন্ম দেবে।
সশস্ত্র ও গণসংগ্রামের প্রক্রিয়ায় এ সকল প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য শত্রুচর এবং স্বার্থান্বেষী মহলের প্রকৃত চরিত্র জনগণের সামনে প্রকাশিত হবে, সত্যিকার দেশপ্রেমিক ও জনগণ তাদেরকে বর্জন করবে এবং এভাবে সশস্ত্র গণসংগ্রামের প্রবল ঝড়-তরঙ্গের মধ্য দিয়ে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক শক্তিসমূহের প্রকৃত ঐক্য গড়ে উঠবে।
ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে এভাবেই দেশপ্রেমিকদের ঐক্য গড়ে উঠেছিল। পূর্ববাংলার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট, সর্বহারা পার্টি ও সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী এ ধরনের ঐক্য গড়ে তোলার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

পরিশিষ্ট ৩

দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি

পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান, সিকিম, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা এবং বার্মাকে নিয়ে দক্ষিণ এশিয়া গঠিত।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ, জনসংখ্যা ও ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ইহা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্ব লাভ করেছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এই দুই বৃহৎ শক্তি দক্ষিণ এশিয়ার কর্তৃত্ব করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, একই সাথে এদেশসমূহে শোষণ-লুন্ঠন অব্যাহত রাখা, জনগণের বিপ্লবী ক্ষমতা প্রতিহত করার জন্য সহযোগিতা করছে। দক্ষিণ এশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে ভারতের উপর নির্ভর করতে দুই বৃহৎ শক্তি প্রথম থেকেই চেষ্টা চালিয়ে আসছে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা দুই বৃহৎ শক্তির কাঁধে ভর করে নিজেকে বৃহৎ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার এবং নিজস্ব প্রভাবাধীন এলাকা তৈরী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহকে নিয়ন্ত্রণ ও তাদের উপর কর্তৃত্ব করা, তাদেরকে শোষণ-লুন্ঠন করার চেষ্টা করে আসছে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পূর্ববাংলার জনগণের জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের সংগ্রামের সুযোগ গ্রহণ করে এবং সোভিয়েটের সহায়তায় পাকিস্তানকে বিভক্ত করে পূর্ববাংলায় নিজস্ব উপনিবেশ কায়েম করে। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা নিজেকে বৃহত্তর শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহকে আণবিক ব্লাকমেইল করার জন্য আণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়।
সে উন্মত্তভাবে সিকিমকে গ্রাস অরে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোকে চাপ প্রয়োগ ও ভাওতা দিয়ে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে।
পাকিস্তানকে দ্বিখন্ডিত করতে ভারতকে সহায়তা করার সোভিয়েট উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরে সোভিয়েট কর্তৃত্ব কায়েম করা।
কিন্তু বৃহৎ শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ভারতীয় অভিলাষের ফলে সোভিয়েটের দক্ষিণ এশিয়ায় কর্তৃত্ব স্থাপন ও প্রভাব বৃদ্ধি বিঘ্নিত হয়ে পড়েছে।
উপরন্তু ভারতীয় অর্থনীতির চরমতম সংকটজনক অবস্থা থেকে ভারতকে উদ্ধারে সহায়তা করার মত আর্থিক সংগতি সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেই।
এ অবস্থার সুযোগ নেয়ার জন্য এগিয়ে আসে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ভারতকে বৃহৎ শক্তি হিসেবে স্বীকার করে প্রভাবাধীন এলাকাকে মেনে নিয়ে ভারতকে মার্কিনের প্রভাবে নিয়ে আসার জন্য মার্কিনীরা সচেষ্ট হয়।
মার্কিন খাদ্য, পুঁজিবাদী ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের আর্থিক সাহায্য দ্বারা ভারতকে সংকট থেকে উদ্ধার করার ভিত্তিতে ভারতকে মার্কিনের প্রভাবে নিয়ে আসার চেষ্টা চলে। মার্কিনের এ প্রচেষ্টায় ভারতের সম্মতি ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
মার্কিনের এ প্রচেষ্টার অপর লক্ষ্য হল দক্ষিণ এশিয়ার পুলিশম্যান হিসেবে ভারতকে ব্যবহার করা [বিরাট দেশ, বিপুল জনসংখ্যা ও সম্পদ], এশিয়ান দিয়ে এশিয়ান পিটানো। দক্ষিণ এশিয়ায় বিপ্লব ঠেকাতে মার্কিন সৈন্যের সরাসরি উপস্থিতি এর ফলে প্রযোজ্য হবে না।
এ কারণেই মার্কিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সফর করে।
পূর্বেও আমাদের সংগঠন উল্লেখ করেছে মার্কিনীরা ভারত-বাংলাদেশ উভয়কেই, এটা না হলে শুধু বাংলাদেশকে প্রভাবাধীনে নিয়ে আসতে চেষ্টা করছে।
বর্তমান মার্কিন নীতির ফলে ভারত-বাংলাদেশ উভয়কেই মার্কিন প্রভাবে নিয়ে আসার সম্ভাবনা জোরদার হচ্ছে।
এ কারণে ভারত-বাংলাদেশ মার্কিনপন্থীদের মন্ত্রীসভায় বিভিন্ন পদে বসায় ও রুশপন্থী বলে কিছু সংখ্যককে বিতাড়িত করে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ও পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন প্রভাব বজায় রাখার জন্য এবং সোভিয়েট নৌবহরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মার্কিনীরা দিয়াগো গার্সিয়াতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে।
মার্কিন, ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার সহায়তায় নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে ভারতকে কাশ্মীর প্রশ্নে ও পূর্ববাংলার প্রশ্নে এবং পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ প্রশ্নে পাকিস্তানের সাথে আপোস করতে হবে। অথবা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এ সকল প্রশ্নে ভারতীয় কর্তৃত্ব মেনে নিলে (তাদের বৃহত্তর স্বার্থে) পাকিস্তান বাধ্য হবে সোভিয়েটের সাথে নতুন সম্পর্ক স্থাপনে বা চীনের সাথে ব্যাপকভাবে সম্পর্ক দৃঢ়তর করতে।
ইতিমধ্যেই ভুট্রোর মস্কো সফর, কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতের প্রতি সোভিয়েটের শর্তহীন সমর্থন প্রত্যাহার ইত্যাদি সোভিয়েটের নতুন নীতি ও মিত্র খুঁজে বের করার চেষ্টার স্বাক্ষর।
দক্ষিণ এশিয়া নিয়ন্ত্রণে বৃহৎ শক্তির এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চললেও আমাদের প্রধান শত্রু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ—এ পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকছে।
উপরন্তু পূর্ববাংলার জনগণের বিপ্লবী ক্ষমতা দখলের লড়াই প্রতিহত করার প্রশ্নে সোভিয়েট-মার্কিন প্রচেষ্টার সমন্বয় যা অতীতে ঘটেছে—বর্তমানেও ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
দুই বৃহৎ শক্তি সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং উপ বৃহৎ শক্তি ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ দক্ষিণ এশিয়াকে শোষণ ও লুন্ঠন, নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যত অপচেষ্টাই করুক না কেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ, জাতি ও জনগণ বিপ্লবের মাধ্যমে তা নস্যাৎ করে দেবে।

পরিশিষ্ট ৪

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে

বর্তমান বিশ্বকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এই দুই বৃহৎ শক্তি হচ্ছে প্রথম বিশ্ব।
পশ্চিম ইউরোপ, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্ব।
এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশসমূহ হচ্ছে তৃতীয় বিশ্ব। চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া ইত্যাদি উন্নয়নশীল সমাজতান্ত্রিক দেশ তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত।
সোভিয়েট ইউনিয়নে পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং পূর্ব-ইউরোপ ও মঙ্গোলিয়ায় সোভিয়েট নিয়ন্ত্রণ থাকায় সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অস্তিত্ব নেই।
চীন, আলবেনিয়া, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, রুমানিয়া ইত্যাদি সমাজতান্ত্রিক দেশের অস্তিত্ব রয়েছে।
এই তিন বিশ্ব পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত ও দ্বন্দ্বপূর্ণ।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বকে নিজেদের মাঝে ভাগ-বাটোয়ারা করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে এবং আবার সহযোগিতাও করছে।
তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকটাই প্রধান।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্ব তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র।
পশ্চিম ইউরোপ ও জাপান, মার্কিন ও সোভিয়েট এই দুই বৃহৎ শক্তির সাথে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপনীত।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং পুঁজিবাদী বিশ্ব মারাত্মক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে পতিত হয়েছে। তারা এ সংকট একে অপরের কাঁধে, নিজেদের জনগণের কাঁধে এবং তৃতীয় বিশ্বের কাঁধে চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। এর ফলে তারা সর্বত্র আরো ব্যাপক প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে।
তৃতীয় বিশ্বভুক্ত এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার অনুন্নত দেশসমূহ সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম জোরদার করছে।
ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওসের জনগণের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের বিজয়, প্যালেস্টাইন ও আরব জনগণের ইসরাইলী ইহুদী জাতীয়তাবাদ বিরোধী সংগ্রাম, আরব জনগণের তৈলকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সংগ্রাম, এঙ্গোলা-মোজাম্বিক-গিনি বিসাউর জনগণের সংগ্রামের বিজয়, লাতিন আমেরিকার জনগণের সামুদ্রিক জলসীমা ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃতির জন্য সংগ্রাম ও তৃতীয় বিশ্বভুক্ত দেশসমূহের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম প্রমাণ করছে তৃতীয় বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে গৌরবময় ভুমিকা পালন করছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাচ্চা বিপ্লবীরা বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীদের থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকার সর্বহারা রাজনৈতিক পার্টি গড়ে তুলছে।
সভাপতি মাও সঠিকভাবে বলেছেন, বর্তমান বিশ্বে ব্যাপক বিশৃংখলা বিরাজ করছে। এটা খারাপ নয়, ভাল। এ বিশৃংখলা বিপ্লবের জন্ম দেবে। শৃংখলা শর্ত হিসেবে কাজ করছে।
দুই বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার দূরভিসন্ধির কারণে বিশ্বে বিশ্বযুদ্ধের আশংকা বিদ্যমান।
বিশেষ করে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক চীনকে অতর্কিতে আক্রমণ করার সম্ভাবনা বিদ্যমান। সে চীন সীমানায় একগুঁয়েভাবে বিপুল সৈন্য মোতায়েন করছে।
এ কারণে বিশ্বের সর্বহারা শ্রেণী, জনগণের সতর্ক থাকতে হবে সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধ বাধাবার পাঁয়তারার বিরুদ্ধে।
তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লবী সংগ্রাম বিশ্বযুদ্ধকে ঠেকাবে বা বিশ্বযুদ্ধ বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করবে।
কিন্তু বিপ্লবই হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের প্রধান প্রবণতা। বিশ্বের দেশসমূহ চায় স্বাধীনতা, জাতি চায় মুক্তি, জনগণ চায় বিপ্লব।