সিরাজ সিকদার রচনাঃ হক-তোয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন প্রভৃতিদের বিরাট তাত্ত্বিক পরাজয় (সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)

সিরাজ সিকদার রচনা

হক-তোয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন প্রভৃতিদের বিরাট তাত্ত্বিক পরাজয়

(সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)

[স্ফুলিঙ্গ ১নং সংখ্যায় প্রকাশিত]

 sikder

হক-তোয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন প্রভৃতি সকলেই “আধা উপনিবেশের উপনিবেশ হয় না, কেবলমাত্র সাম্রাজ্যবাদ ব্যতীত কেহ উপনিবেশিক শোষণ চালাতে পারে না”—বলে উল্লেখ করেছে।

এটা তাদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক লাইন ছিল। এ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই তাদের রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক লাইন গড়ে উঠেছে। এটা তাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।

হক-তোয়াহাদের এ তত্ত্বকে কাজী, আমজাদ, বারী, আয়ুব রেজা এবং ফজলু চক্রের অবশিষ্টাংশ আমাদের আক্রমণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।

এ তত্ত্ব দ্বারা তারা “পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলন” এবং পূর্ববাংলার সর্বহারার পার্টিকে বিরোধিতা করেছে, বর্তমানেও বিরোধিতা করছে।

পূর্ববাংলার শ্রমিক আন্দোলন ও সর্বহারা পার্টি, সাম্রাজ্যবাদ ছাড়াও আধা উপনিবেশিক দেশ উপনিবেশ কায়েম এবং উপনিবেশিক শোষণ করতে পারে বলে উল্লেখ করে।

এ প্রশ্ন নিয়ে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিরাট তাত্ত্বিক বিতর্ক চলে।

“আধা-উপনিবেশিক দেশও উপনিবেশ কায়েম এবং উপনিবেশিক শোষণ করতে পারে” হক-তোয়াহাদের মতে আমাদের এ সঠিক তত্ত্ব নাকি সাম্রাজ্যবাদকে গৌণ করে ফেলে। এ কারণে তারা আমাদেরকে সাম্রাজ্যবাদের দালাল বলত।

“আধা উপনিবেশের উপনিবেশ হতে পারে না”—এ তত্ত্ব থেকে হক-তোয়াহারা পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের পূর্ববাংলার উপর পরিচালিত উপনিবেশিক শোষণকে অস্বীকার করছে।

বর্তমানেও এ তত্ত্বের কারণে তারা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ কর্তৃক পূর্ববাংলার উপর পরিচালিত উপনিবেশিক শোষণকে অস্বীকার করছে।

হক সাহেব পূর্ববাংলাকে সোভিয়েটের উপনিবেশ এবং ভারত তা তদারক করছে বলে উল্লেখ করছে।

তোয়াহা সাহেব পূর্ববাংলাকে ভারতের আশ্রিত রাজ্য, সোভিয়েটের নয়া উপনিবেশ বলছে। আর মতিনরা বলছে “আধা উপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী পূর্ববাংলা”।

এভাবে “আধা উপনিবেশের উপনিবেশ হতে পারে না”—এ তত্ত্বের দ্বারা পরিচালিত হয়ে তারা প্রধান দ্বন্দ্ব এবং প্রধান শত্রু নির্ণয়ে ভুল করছে, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, কর্মীদের ভুল পথে পরিচালনা করছে, দুর্বোধ্যতার আশ্রয় নিয়ে কর্মীদের হতাশ করছে।

সম্প্রতি চীনের ‘পিপলস ডেইলী’তে প্রকাশিত একটি ভাষ্যে (রেডিও পিকিং প্রচারিত ৩/৭/৭৪) সিকিমকে ভারতের উপনিবেশ, ভারত সিকিমে উপনিবেশিক শোষণ চালাচ্ছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর বৃটিশদের অনুরূপ ভারত উপনিবেশিক সম্প্রসারণবাদী কার্যকলাপ চালাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়।

হক-তোয়াহা যাকে আশ্রিত রাজ্য বলেছে ভাষ্যকার তাকে উপনিবেশ বলেছেন।

ভারত একটি আধা উপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী দেশ।

উপরোক্ত ভাষ্য থেকে দেখা যায়, ভারত আধা উপনিবেশিক দেশ হয়েও উপনিবেশ কায়েম এবং উপনিবেশিক শোষণ চালাতে সক্ষম।

উপরোক্ত ভাষ্য হক-তোয়াহাদের “আধা উপনিবেশের উপনিবেশ হয় না”—তত্ত্বের চরম ভ্রান্তি প্রমাণ করেছে; পক্ষান্তরে, আমাদের তাত্ত্বিক সঠিকতা প্রমাণ করেছে।

ইহা হক-তোয়াহা-মতিনদের বিরাট পরাজয় এবং আমাদের একটি বিরাট বিজয়।

হক-তোয়াহারা যে তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছিল তার ভ্রান্তি, পক্ষান্তরে আমাদের তাত্ত্বিক সঠিকতা প্রমাণ হয়েছে।

আমরা আশা করি, হক-তোয়াহা-মতিন-আলাউদ্দিন ইত্যাদি গ্রুপগুলোর মধ্যকার আন্তরিক বিপ্লবীরা উপরোক্ত তাত্ত্বিক বিতর্কের ফলাফলের উপলব্ধি করবেন এবং সঠিক তাত্ত্বিক লাইন দ্বারা পরিচালিত সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ হবেন।

►◄

সিকিমে ভারতের সম্প্রসারণবাদী কার্যকলাপের স্বরূপ উদ্ঘাটন করে চীনের পিপলস ডেইলী একটি ভাষ্য প্রকাশ করেছে। ভাষ্যটির পূর্ণপাঠ নিম্নরূপঃ

সম্প্রতি সিকিমে পূর্ণ জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের জোর দাবী উঠেছে। এই দাবী ভারত সরকারের কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। সিকিমকে ভারতের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং ভারতের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ভারত সরকার এখন সিকিমের রাজাকে সমস্ত ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টায় লিপ্ত। ভারত সরকারের এ আচরণের মধ্য দিয়ে তার সম্প্রসারণবাদী কুৎসিত চেহারা আর একবার প্রকাশিত হয়ে উঠেছে। অবশ্য এতে সিকিমের জনগণের মধ্যে প্রতিরোধের একটি দুর্জয় দুর্গ গড়ে উঠেছে।

এ বছরের এপ্রিল মাসে সিকিমে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভারত সরকারের পরিচালনায় এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বলে সিকিমের ভারতপন্থীরা জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। ৩০শে জুন তারিখে ভারত সরকার এই জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে একটি খসড়া শাসনতন্ত্র উপস্থিত করে। এ শাসনতন্ত্র অনুযায়ী রাজা একজন শিখণ্ডী রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে থাকবেন মাত্র। সিকিমের রাজা স্বাধীনতা ও স্বীয় স্বাতন্ত্র্যের পক্ষপাতি। কিন্তু ভারত সরকার সংস্কার সাধনের নামে সিকিমকে একটি তাবেদার রাজ্যে পরিণত করতে চায়। ভারত সরকার রচিত শাসনতন্ত্রের বিধানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, ভারতের নির্বাচিত একজন তথাকথিত প্রধান প্রশাসক সিকিমের সব ক্ষমতার অধিকারী হবে। খসড়া শাসনতন্ত্রে খোলাখুলিভাবে বলা হয়েছে যে, সিকিম সরকার ভারতের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং সিকিমের উন্নয়ন পরিকল্পনা ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের কাজকর্মের আওতাভুক্ত থাকবে। বাস্তবে এর অর্থ হলো, সিকিমের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম অধিকার কুক্ষিগত করা এবং সিকিমকে ভারতের একটি উপনিবেশে পরিণত করা।

সিকিমের রাজা ভারতের এই প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ, নির্লজ্জ নিয়ন্ত্রণ ও বলিষ্ঠ চাপ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছেন। তিনি ভারত কর্তৃক সিকিমের গ্রাস করার বিরোধিতা করা এবং সিকিমের আলাদা অস্তিত্ব, রাজনৈতিক মর্যাদা বজায় রাখার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। নয়া দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এক বৈঠকের পর তিনি তার একজন সহকারীর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন যে তিনি ভারতের চাপের কাছে নতি স্বীকার করবেন না। তার ন্যায়সঙ্গত মনোভাব সিকিমের জনগণের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে।

সিকিমের বিরুদ্ধে ভারতের এই ধরণের নগ্ন সম্প্রসারণবাদী কার্যকলাপে বিশ্বের সকল ন্যায়বিচারকামী দেশ ও জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন।

দেশ চায় স্বাধীনতা, জাতি চায় মুক্তি, আর জনগণ চায় বিপ্লব—এটাই হলো বর্তমান দুনিয়ার একটি অপ্রতিরোধ্য স্রোত।

তৃতীয় বিশের অন্তর্ভুক্ত এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও ওশেনিয়ার বহু উপনিবেশিক, আশ্রিত এবং পরাধীন দেশ সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের নিগঢ় থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে।

কিন্তু শুধু ভারতই স্বাধীনতা অর্জনের পরও বৃটেনের ঊনবিংশ শতাব্দীর উপনিবেশবাদী নীতি অনুসরণ করে সিকিমকে নিজের অধীন রাজ্য হিসেবে গ্রহণ করে তার উপর উপনিবেশবাদী শাসন চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত সরকার সিকিমে সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করে পররাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ সিকিমের সমস্ত আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। শুধু তা নয়, বরং এখন সে সিকিমের রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিকিমকে সম্পূর্ণরূপে পদানত করারও অপচেষ্টা করছে। ভারত সরকার নির্লজ্জভাবে সিকিমের সার্বভৌমত্ব পদদলিত করে পুরোপুরি উপনিবেশবাদী সম্প্রসারণবাদী সম্প্রসারণ চালাচ্ছে। তাদের এই হীন কার্যকলাপের সঙ্গে বর্তমান দুনিয়ার গতিস্রোতের কোন মিল নেই।

এঙ্গেলস বলেছেন, “বিশ্বে এমন কোন লোক নেই যাদেরকে কোন একটি জাতিকে নির্যাতন করে শাস্তি ভোগ করতে হয়নি।”

ইতিহাস প্রমাণ করেছে এবং প্রমাণ করবে যে, কোন জাতিকে উৎপীড়ন করার নীতি সেই নিপীড়িত জাতির মধ্যে প্রতিরোধ সংগ্রামেরই জন্ম দেয় মাত্র।

সিকিমের জনগণের বিরুদ্ধে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের এইসব অপরাধমূলক কার্যকলাপ থেকে সৃষ্ট কুফল তাকেই ভোগ করতে হবে।