সিরাজ সিকদার রচনাঃ অঞ্চল পরিচালক এবং গুরুত্বপূর্ণ কমরেডদের সাথে প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির বৈঠক শেষে প্রকাশিত ইশতেহার (সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)

সিরাজ সিকদার রচনা

অঞ্চল পরিচালক এবং গুরুত্বপূর্ণ কমরেডদের সাথে প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির বৈঠক শেষে প্রকাশিত ইশতেহার

(সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)

 sikder

সভায় অঞ্চল পরিচালক ও গুরুত্বপূর্ণ কমরেডগণ উপস্থিত ছিলেন।

সভায় সাংগঠনিক, মতাদর্শগত ও তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, সামরিক এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।

সভায় সভাপতি প্রদত্ত রিপোর্ট কমরেডরা পর্যালোচনা করেন এবং তা গ্রহন করেন।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা পর্যালোচনা করা হয়।

অনুশীলনের সাথে যুক্ত পরীক্ষিত এবং নূতন সম্ভাবনাময় বহু কর্মী সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে যুক্ত হয়েছে এবং হচ্ছে।

এদেরকে মানোন্নয়ন এবং তাত্ত্বিক হিসেবে গড়ে তোলার পদ্ধতি ঠিক করা হয়।

পূর্ববাংলার সর্বহারার পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির পুনর্গঠন করা হয় এবং কেন্দ্রীয় সংস্থা ও তার পরিচালনার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়।

তাত্ত্বিক ও মতাদর্শগত

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টিতে ব্যাপক নতুন কর্মী বিভিন্ন স্তরে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে। অনুশীলনের সাথে যুক্ত এবং পরীক্ষিত এরূপ পুরোনো কর্মীও রয়েছে।

অনুশীলনের সাথে যুক্ত ও পরীক্ষিত সম্ভাবনাময় এবং নতুন কর্মীদের মানোন্নয়ন, বিশেষ করে তাত্ত্বিক মানোন্নয়ন ও তাত্ত্বিক সৃষ্টি সংগঠনের জন্য একান্ত অপরিহার্য।

অনুশীলনে যুক্ত নয় এরূপ তত্ত্বজানা গোড়ামীবাদীদের প্রাধান্য অপসারণের জন্য সংগঠনে গোড়ামীবাদ বিরোধী সংগ্রাম পরিচালনা করা হয়েছে। এর ফলে গোড়ামীবাদ ধিকৃত হয়েছে।

গোড়ামীবাদ পরিহার করে আমরা যদি তত্ত্ব অধ্যয়ন এবং তাত্ত্বিক মানোন্নয়ন, অনুশীলনের সাথে যুক্ত তাত্ত্বিক গড়ে না তুলি তবে সংগঠনে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদের প্রাধান্য পাবে এবং সংগঠন বিপ্লব পরিচালনা করতে ব্যর্থ হবে। কাজেই তাত্ত্বিক মানোন্নয়ন ও তাত্ত্বিক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ‘মার্কসবাদ উত্তমরূপে অধ্যয়ন ও রপ্তকরণের আন্দোলন’ চালাতে হবে; বিশেষ করে অনুশীলনের সাথে যুক্ত এবং পরীক্ষিত, সম্ভাবনাময় এবং নূতন সম্ভানবনাময়দের গুরুত্ব সহকারে স্তর অনুযায়ী তত্ত্ব অধ্যয়ন ও রপ্ত করতে হবে।

এ তত্ত্ব অধ্যয়নের উদ্দেশ্য হবে সংশোধনবাদী ও ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শকে সংগ্রাম ও পরিহার করা, পূর্ববাংলার বিশেষ অবস্থার সাথে মার্কসবাদের সমন্বয় সাধন করা।

ছ’মাসের মাঝে এ আন্দোলন পরিচালনার প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচী কর্মীদের পাঠ করানো সম্পন্ন করা।

এ উদ্দেশ্যে অধ্যয়ন ও লেখক গ্রুপ তৈরী করা। এরা মার্কসবাদ অধ্যয়ন ও তা আলোচনা, লেখা ইত্যাদির দায়িত্ব নেবে।

সামরিক

সামরিক ক্ষেত্রে বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ আরো জোরদার করতে হবে।

শত্রুর চাপ বৃদ্ধি এবং আমাদের ব্যাপক কর্মী রদবদলের ফলে বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ বিকাশ ধীরগতিতে চলছে।

বর্তমানে রদবদল সম্পূর্ণ হয়েছে। শত্রুর চাপ হ্রাস পেয়েছে। কাজেই রণনৈতিক আক্রমণ জোরদার এবং ৩০শে এপ্রিলের বিবৃতির লক্ষ্য বাস্তুবায়নের দিকে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যেতে হবে।

গুরুত্বপূর্ণ কর্মীদের অপারেশনে অংশ গ্রহণ না করা, সম্ভাবনাময় গেরিলা কমান্ডার, পরিচালকদের রক্ষা করার নীতি বজায় রাখতে হবে।

অঞ্চলভিত্তিক সামরিক অপারেশন টার্গেট লিস্ট বিশ্লেষণ সহ তৈরী করে ক্রমান্বয়ে জটিলতর অপারেশনের দিকে যেতে হবে। ফলে বিপর্যয় কম হবে।

সামরিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অপারেশন চালিয়ে যেতে হবে।

জাতীয় শত্রুর আত্মসমর্পণ গ্রহণ করা, গ্রামভিত্তিক চাঁদা গ্রহণ কার্যকরী করতে হবে। এভাবে প্রতি উপ অঞ্চল, অঞ্চলকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে।

জাতীয় শত্রু খতম চালিয়ে গ্রামকে মুক্ত, অপারেশন পূর্বে স্থানীয় জনমত তৈরী ইত্যাদি করতে হবে।

গ্রেপ্তারকৃত কমরেডদের মুক্তির জন্য আইনগত ও অন্যান্য পদ্ধতি অবলম্বন করে তাদের যথাসম্ভব শীঘ্র মুক্ত করতে হবে।

এবারকার বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণে শহীদ কমরেডদের জন্য শোক জ্ঞাপন করা হচ্ছে।

শহীদ ও গ্রেপ্তারকৃতদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ়ভাবে বিপ্লবী কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

রাজনৈতিক

পূর্ববাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অতিশয় চমৎকার।

আওয়ামী লীগ ও তার প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের ইতিহাসের নির্মমতম শোষণ ও লুন্ঠনের ফলে পূর্ববাংলা আজ চরমতম আর্থিক সংকটে পতিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বন্যা এ সংকটকে আরো তীব্রতর করছে। ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চাকুরীর সংকট পূর্ববাংলার জনগণকে ইতিহাসের সবচাইতে খারাপ অবস্থায় ফেলেছে।

জনগণ চায় বিপ্লব, দেশ চায় স্বাধীনতা, জাতি চায় মুক্তি।

আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক পুতুল সরকার ও তার প্রভুদের উপর জনগণ চরমভাবে বিক্ষুব্ধ, তারা বিদ্রোহ উন্মুখ। তারা অতি সত্ত্বর আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের উৎখাত করে স্বাধীনতা, শান্তি, গণতন্ত্র চান; খেয়ে পরে বাঁচতে চান।

আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের লেজুড় মনি-মোজাফফর সংশোধনবাদীরা জনগণের নিকট পুরোপুরি দালাল হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। তাদের ভাঙ্গন ও পতন চলছে।

জনগণকে পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকাশ্য দলসমূহ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে।

হক-তোয়াহা-মতিন প্রভৃতিও জনগণকে পরিচালনার সম্পূর্ণ অক্ষম বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং জনগণের আস্থা হারিয়েছে। তাদেরও পতন এবং ভাঙ্গন চলছে।

পক্ষান্তরে পূর্ববাংলার সর্বহারার পার্টি ব্যাপক জনসমর্থন অর্জন করেছে, পার্টির প্রতি জনগণের আস্থা দৃঢ়তর হচ্ছে।

একমাত্র পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টিই পূর্ববাংলার মুক্তি আনতে সক্ষম—জনগণের মাঝে এ ধারণা দৃঢ়তর হচ্ছে।

জনগণ বিভিন্ন স্থানে নিজেরাই আমাদের সাথে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসছে। আমাদের পরিচয় পেলে নিরাপদে সরে পড়ায় সহযোগিতা করছে। তারা আমাদেরকে তাদের মুক্তিদাতা বলে গ্রহণ করছে। তারা দ্রুত আমাদের…করছে।

আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ মারাত্মক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটে পতিত হয়েছে।

সে নিজেকে একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পায়তারায় একটি আণবিক বোমা ফাটিয়েছে। এর সাহায্যে দক্ষিণ এশিয়ায় আণবিক ব্ল্যাকমেইল করা, প্রতিবেশী দেশসমূহে নিয়ন্ত্রণ, হস্তক্ষেপ করা, দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরে নিজস্ব প্রভাবাধীন এলাকা তৈরীর প্রয়াস চালাচ্ছে।

ইতিমধ্যেই সে পূর্ববাংলায় উপনিবেশ কায়েম করেছে, সিকিমকে গ্রাস করে সেখানে উপনিবেশিক শোষণ কায়েম করেছে।

তার এ সকল জঘন্য কার্যকলাপে সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ সহায়তা ও সমর্থন জোগাচ্ছে।

ভারতীয় জনগণ, পূর্ববাংলার জনগণ, সিকিমের জনগণ, দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে উৎখাতের জন্য সংগ্রাম জোরদার করছে। উপরন্তু মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীরা এবং পুঁজিবাদী পশ্চিম ইউরোপ ও জাপান, দক্ষিণ এশিয়া নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে ভারত সোভিয়েটের সাথে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। মুসলিম বিশ্ব এবং তৃতীয় বিশ্ব দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের নিয়ন্ত্রণকে বিরোধিতা করছে। এভাবে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ব্যাপকতর প্রতিরোধ ও বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে যা তার পতনকে দ্রুততর করছে।

পূর্ববাংলার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির একক বিরোধী শক্তি হিসেবে বিকাশ পূর্ববাংলার অভ্যন্তরস্থ ও বাইরের বিভিন্ন ভারত-সোভিয়েট বিরোধী মহলকে আমাদের সাথে সহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ করছে।

পূর্ববাংলার অভ্যন্তরে ভারত-সোভিয়েট বিরোধী বিভিন্ন মহল আমাদের সাথে সংযোগ করছে।

দেশের বাইরের ও বিভিন্ন মহলের সাথে সংযোগ স্থাপনের প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের নমনীয় লাইন ভারত-সোভিয়েট বিরোধী শক্তিসমূহের সংযোগ ও সহায়তাকে সম্ভব করে তুলেছে।

এ অবস্থায় আমাদের শক্তিকে আরো বাড়াতে হবে, স্বাধীনতা ও উদ্যোগ আমাদের হাতে বজায় রাখতে হবে, দেশব্যাপী জনগণকে আমাদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। সশস্ত্র সংগ্রামের সাথে গণসংগ্রামকে জোরদার করতে হবে।

আমাদের নিজস্ব ঐক্য, শক্তি, দেশীয় আন্তর্জাতিক সহায়তা ডেকে আনবে এবং সম্ভব করে তুলবে।

এ কারণে আমাদের ঐক্য ও শক্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি একান্ত প্রয়োজন।

একই পথে…সাথে সর্বদা আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের কু’দেতা-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে।

এরূপ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাব্য ভারতীয় হস্তক্ষেপ এবং পঁচিশে মার্চের মত অবস্থার উদ্ভব হলে পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণের জন্য আমাদেরকে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে।