সিরাজ সিকদার রচনাঃ বাংলা সাহিত্যের জাতীয় গণতান্ত্রিক লেখক-শরৎচন্দ্র (সেপ্টেম্বর ১৯৭৪) [স্ফুলিঙ্গ প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত]

সিরাজ সিকদার রচনা

বাংলা সাহিত্যের জাতীয়

গণতান্ত্রিক লেখক-শরৎচন্দ্র

(সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)

[স্ফুলিঙ্গ প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত]

 sikder

[স্ফুলিঙ্গ প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত এ লেখাটি অসমাপ্ত রয়ে গেছে শত্রুর হাতে কমরেড সিরাজ সিকদার শহীদ হওয়ার কারণে। শরত চন্দ্র ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলা উপন্যাসিক। তাঁর রচনাকাল বিশ শতকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল। তাঁর লেখনির মাধ্যমে তিনি ব্রিটিশ উপনিবেশবাদকে বিরোধিতা করেছেন, সশস্ত্র সংগ্রামের পথকে সমর্থন করেছেন, ধর্মীয় নিপীড়ণকে বিরোধিতা করেছেন, আর নারীদের প্রতি জানিয়েছেন সহানুভূতি। তিনি ছিলেন খুবই গণতন্ত্রমনা, নারী ও পুরুষের সম্পর্কটা তাঁর আছে ছিল প্রেম ও সমতাভিত্তিক, আচার অনুষ্ঠান নয়। সামন্ততান্ত্রিক ধ্যান ধারণার উপর তিনি আঘাত করেছেন। ধর্মবাদী শ্রেণী দ্বন্দ্ব তাঁর লেখায় উঠে এসেছে। পুরনো সমাজ ভেঙে যাছে, কৃষক শ্রমিকে রূপান্তরিত হচ্ছে এসব তিনি তুলে ধরেছেন আর দরিদ্র মানুষের প্রতি তাঁর ভালবাসা। এসবকিছু সত্ত্বেও তিনি সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা, আচার, ধর্ম এড়াতে পারেননি কারণ তিনি সর্বহারা বিপ্লবী ছিলেন না। শরত চন্দ্র এখনো আগের মতই জনপ্রিয়, আর সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় তিনি ছিলেন সর্বহারা শ্রেণীর একজন ভাল বন্ধু। আমাদেরকে শরত চন্দ্রের সকল রচনা একের পর এক বিচারমূলকভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে আর এভাবে কমরেড সিরাজ সিকদারের অসমাপ্ত বিপ্লবী কাজকে সমাপ্ত করতে হবে। — সর্বহারা পথ]

বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় জাতীয় গণতান্ত্রিক লেখক হিসেবে কাকে আমরা তুলে ধরতে পারি? এটা সাহিত্য–সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

জাতীয় গণতান্ত্রিক লেখক বলতে আমরা বুঝি এমন সাহিত্যিক যিনি আপোষহীনভাবে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদকে বিরোধিতা করেছেন।

বাংলা সাহিত্যে শরতচন্দ্রই হচ্ছেন জনপ্রিয় জাতীয় গণতান্ত্রিক লেখক।

তিনি তৎকালীন বৃটিশ উপনিবেশবাদীদের আপোষহীনভাবে বিরোধিতা করেছেন, এবং তাদেরকে উতখাতের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের পথকে তুলে ধরেছেন, একে প্রশংসা করেছেন।

বিপ্লবীদের তিনি আন্তরিকতার সাথে তাদের পক্ষ নিয়ে চিত্রিত করেছেন। (শরৎচন্দ্র মার্কসবাদী ছিলেন না। এ কারণে সশস্ত্র সংগ্রামকে জনগণের সাথে যুক্ত, ঘাটি এলাকা গঠন, কৃষকদের অংশগ্রহণ, সর্বহারা পার্টির নেতৃত্ব ইত্যাদি তুলে ধরতে পারেনি)।

ভারতের তখনকার বৃটিশদের দালাল রাজনীতিবিদ ও সাহিত্যিকদের (গান্ধির অহিংস পথ, রবীন্দ্রনাথ) অহিংস পথ সশস্ত্র সংগ্রামের বিরোধিতা, বিপ্লবীদের ব্যর্থতা ও খারাপ হিসেবে চিত্রিত করার বিপরীতে শরতচন্দ্রের লেখা একটি বলিষ্ঠ জবাব ছিল। এ কারণে শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ বৃটিশদের দ্বারা বাজারে প্রকাশ নিষিদ্ধ ছিল।

সমান্তবাদ সাম্রাজ্যবাদের টিকে থাকার ভিত্তি এবং কৃষক-জনগণকে শোষণের হাতিয়ার। শরৎচন্দ্র সামন্তবাদী ধ্যানধারণা, আচার-অনুষ্ঠান, সামন্ত-জমিদারদের নিষ্ঠুর শোষণ লুণ্ঠনকে এবং জনগণের সামন্ত বিরোধী মনোভাবকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।

অবিভক্ত ভারতে সামন্তবাদীদের শোষণের একটি রূপ ছিল মুসলিম জনগণের উপর নিষ্ঠুর ধর্মীয় নিপীড়ন।

শরতচন্দ্রই একমাত্র লেখক যিন্তি একে মর্মস্পর্শীভাবে চিত্রিত করেছেন। সামন্তবাদের অবক্ষয়, কৃষদের ভূমি থেকে উৎখাত এবং শ্রমিকে রূপান্তরের সামাজিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে তুলে ধরেছেন। শরৎচন্দ্রের মহেশ গল্পটি এ কারণে ঐতিহাসিক রচনা।

পাক-ভারত উপমহাদেশের বিভক্তির কারণ এখানেই পাওয়া যায়।

শরৎচন্দ্র সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ দ্বারা নিপীড়িতা, নির্যাতিতা নারীদের দুঃখ বেদনাকে মর্মস্পর্শী রূপ দিয়েছেন, নিপীড়িতা নারীদের সমর্থন করেছেন।

তিনি সামন্তবাদী ধ্যানধারণাকে ভেঙ্গে ফেলা, নারী-পুরুষের সমধিকার, সমাজের হস্তক্ষেপ ব্যতীত নরনারীদের স্বেচ্ছাভিত্তিক সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে সর্বদাই দৃঢ় থেকেছেন।

আচার অনুষ্ঠান নয়, নরনারীদের ভালবাসাই হচ্ছে সম্পর্কের ভিত্তি এটা তিনি তুলে ধরেছেন।

ভারতের তৎকালীন সমান্ততান্ত্রিক সমাজের প্রতি শরৎচন্দ্রের এ সকল ধ্যানধারণা একটা বিরাট বিদ্রোহ হিসেবে কাজ করেছে।

এ কারনে ভারতে সামন্তবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদীরা কখনোই তাকে পছন্দ করেনি।

শরৎচন্দ্রকে এ কারণেই সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল ভারতের বর্তমান আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ও সামন্তবাদী শাসক গোষ্ঠী এবং তাদের উপর নির্ভরশীল বুদ্ধিজীবিরা বিরোধিতা করেছে।

বর্তমানে তারা তাদের বিরোধিতার রূপ পরিবর্তন করে বলছে শরৎচন্দ্র পুরানো হয়ে গেছে ইত্যাদি।

‘পুরানো হয়ে গেছে’ বলে তারা তথাকথিত আধুনিক সাহিত্যিক যারা সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের উপর নির্ভরশীল প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্যিক শিল্পীদের তুলে ধরছে।

এভাবে তারা সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করছে।

সাহিত্য-শিল্পকলা হচ্ছে উপরিকাঠামোর অঙ্গ। ইহা মানুষের মতাদর্শকে নিয়ন্ত্রণ করে। কাজেই ভারত এবং বাংলাদেশে সাহিত্য শিল্পকলার মাধ্যমে উপরিকাঠামোর মতাদর্শগত ক্ষেত্রে সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করে তাদের টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।

কিন্তু আপামর জনসাধারণ এ অপচেষ্টার বিপক্ষে। এ কারণে এখনো আধুনিক প্রতিক্রিয়াশীল লেখকদের চেয়ে শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তা এবং তার পাঠক সংখ্যা বেশী।

(অসম্পূর্ণ)