সিরাজ সিকদার রচনাঃ বিশেষ সামরিক অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডারদের সাথে বৈঠক শেষে অনুমোদিত সিদ্ধান্তসমূহ

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার


পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ মধ্য ১৯৭৩

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ১৪ নভেম্বর ২০১৪


পিডিএফ

○ বৈঠকে পূর্ববাংলার সামরিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। (পরিশিষ্ট-১)

এ পরিপ্রেক্ষিতে ভোলায় উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য জনৈক কমরেডকে সমালোচনা করা হয়। (পরিশিষ্ট-২)

○ আমাদের সামরিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয় এবং ব্যাপক গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার মত আমাদের প্রস্তুতি অর্জিত হয়েছে বলে জানা যায়।

১নং সেক্টরভুক্ত সকল অঞ্চলে ব্যাপক সামরিক তৎপরতা শুরু করার জন্য আহবান জানানো হচ্ছে। অনুমতি সংক্রান্ত নিয়মাবলী পূর্বের মত।

বর্তমানে আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে সামরিক কাজ।

এটা করার সময় একতরফাবাদী ভুল হতে পারে অর্থাৎ সমগ্র দিক বিবেচনা না করা, গৌণ কাজসমূহ বাদ দেওয়া বা কম গুরুত্ব দেওয়া, শুধু প্রধান কাজ করা প্রভৃতি হতে পারে।

এটা হলে আমাদের আশানুরূপ লাভ হবে না বরঞ্চ ক্ষতি হতে পারে, সমগ্র গৌণ কাজের সফলতা প্রধান কাজের সফলতার সাথে যুক্ত, দ্বিতীয়তঃ সামরিক সফলতা অর্থহীন হবে যদি তার ফলসমূহ গৌণ কাজের মাধ্যমে ধরে রাখতে না পারা যায়।

পেয়ারা বাগান, ২নং ফ্রন্টে সামরিক কাজের মাধ্যমে ধরে রাখা হয়নি। ফলে আশানুরূপ ফল লাভ, কর্মী, স্থানীয় কাজ, শেল্টার, অর্থ অর্জিত হয়নি। এ ভুলের পুনরাবৃত্তি হলে চলবে না।

গৌণ কাজ হচ্ছেঃ

▬ সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য এলাকা নির্বাচন;

▬ সাংগঠনিক কাজ;

▬ প্রচার;

▬ যোগাযোগ পদ্ধতি;

▬ অর্থ;

▬ অনুসন্ধান;

▬ মানোন্নয়ন সারসংকলন;

▬ অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণ;

▬ ব্যাপক শেল্টার গড়ে তোলা;

সামরিক কাজ প্রধান হলেও মতাদর্শগত কাজকে এর চেয়ে প্রাধান্য দিতে হবে যেহেতু চিন্তা কর্মকে নিয়ন্ত্রিত করে।

এ কারণে সমগ্র কাজে চিন্তাধারাকে পরিবর্তন ও কর্মরীতিকে সংশোধন এবং কমরেড সিরাজ সিকদারের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণের মতাদর্শগত আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।

○ সমগ্র অঞ্চলের মধ্যে আমাদের কাজ, শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের অবস্থা, ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনা করে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য এক বা একাধিক অঞ্চল আঁকড়ে ধরতে হবে।

○ সাংগঠনিক কাজ পরিচালনার জন্য স্থানীয় সাংগঠনিক টিম/গ্রুপ/কমিটি গড়ে তোলা যারা সাংগঠনিক দায়িত্বাদি পালন করবে, সশস্ত্র সংগ্রামে নিয়োযিত কমরেডদের সাথে সাংগঠনিক কাজ সমন্বিত করবে।

সশস্ত্র সংগ্রামের ফলে বিস্তৃত অঞ্চলের জনগণ পার্টিতে যোগদান করতে ইচ্ছুক হবেন। সাংগঠনিক টিমের মাধ্যমে তাদের সংগঠিত করা।

এরা স্থানীয় প্রচার, যোগাযোগ, অর্থ, মানোন্নয়ন, জাতীয় শত্রু খতম (নিয়মিত বাহিনীর জন্য শেল্টার) অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত কমরেডদের জন্য শেল্টার ব্যবস্থা, অনুসন্ধান প্রভৃতি কাজ করবে।

যে সকল অঞ্চলে নিয়মিত বাহিনী গড়ে তোলা হবে/গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে নেতৃস্থানীয় কর্মী ব্যাপৃত থাকবে সেখানে এ ব্যবস্থা প্রয়োজন।

সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপ-অঞ্চল, এলাকার কাজ সুসংবদ্ধ করা, সশস্ত্র সংগ্রাম করার জন্য অঞ্চলভুক্ত কম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, সশস্ত্র সংগ্রাম চলবে না এরূপ এলাকা থেকে গুরুত্বপূর্ণ কর্মী, গেরিলা প্রত্যাহার করা। প্রত্যাহারকৃত এলাকার জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ কমরেড নিয়োগ করা।

▬ নিয়মিত বাহিনী নিজের মধ্যে ও বাইরে জনগণের মাঝে সাংগঠনিক কাজ করবে।

▬ প্রচার স্থানীয় বাহিনী ও নিয়মিত বাহিনী উভয়েই পরিচালনা করবে। সশস্ত্র প্রচার টিমের ব্যাপক তৎপরতা চালাতে হবে।

▬ যোগাযোগ পদ্ধতি উন্নত করা, কুরিয়ার স্থানীয় ও নিয়মিত উভয়ের জন্য নিয়োগ, যোগাযোগ কেন্দ্র গড়ে তোলা, নিয়মিত কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ রাখা।

কুরিয়ার ও কেন্দ্র একাধিক হওয়া বাঞ্চনীয়।

প্রতি অঞ্চলের জন্য যোগাযোগ কেন্দ্র ও কুরিয়ার হলে ভাল হয়।

কোন অবস্থায়ই যেন নিজেদের মধ্যে ও উচ্চস্তরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়।

ওয়ারলেস, ওয়াকিটকির মাধ্যমে আন্তঃসেক্টর যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

▬ অর্থ ও মূল্যবান সম্পদ, দখলকৃত এবং সহানুভূতিশীল প্রদত্ত অর্থ ও সম্পদ উচ্চস্তরে জমা দেওয়া।

▬ অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য অর্জন করা।

▬ নিয়মিত বাহিনীর ও স্থানীয় কাজের কর্মী ও গেরিলাদের মানোন্নয়ন করা, শিক্ষা সম্মেলন, সারসংকলন সভা প্রভৃতি করা উচিত।

তাদের কার্যাবলী এবং সশস্ত্র সংগ্রাম চলছে না এরূপ অঞ্চলের কার্যাবলী তদারক করা এবং উপরের কাজগুলো করার জন্য কর্মী নিয়োগ করা। নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করা।

এর ফলে সমগ্র সংগঠন এবং সশস্ত্র সংগঠনের উপর যথাযথ নজর থাকবে।

অস্ত্রশস্ত্র দখল করা ও সংরক্ষণ করা উচিত।

▬ ব্যাপক শেল্টার গড়ে তোলা উচিত।

○ কমরেড সিরাজ সিকদারের সাথে বিশেষ সামরিক অঞ্চলের সেক্টর কমান্ডারদের বৈঠক শেষে ১নং সিদ্ধান্ত সমূহ, ১-ক উপব্যুরোর সাথে ব্যুরো পরিচালকের বৈঠক শেষে সিদ্ধান্তসমূহ, সামরিক অপারেশন সংক্রান্ত কতিপয় গাইড অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে।

সামরিক কাজে একতরফাবাদী ভুল যাতে না হয় সে বিষয়ে খুবই সতর্ক হতে হবে।

একতরফাবাদী ভুলের ফলে সামরিক কাজ ব্যর্থ হতে বাধ্য।

উদাহারণস্বরূপ পেয়ারা বাগান থেকে প্রত্যাহার না হলে কি কি লাভ হবে তা বিবেচনা করা হয়নি, এর ফলে প্রত্যাহার না হলে যে সকল ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটত তা ঘটেনি।

নিম্নলিখিত দিকসমূহ এবং তাদের মধ্যকার সম্পর্ক সামরিক কার্যাবলী পরিচালনার সময় খেয়াল রাখতে হবে।

১। জাতীয় শত্রু খতম করা বা শত্রু ঘাঁটি দখল করা বা উভয়ই করা।

২। গৌণ কাজের সাথে সামরিক কাজের সম্পর্ক।

৩। গেরিলা অঞ্চল রাখা না ঘাঁটি গঠনের পক্ষে।

৪। প্রত্যাহার হতে হবে না টিকে থাকতে হবে।

৫। ট্রেনিংস্থল, আক্রমণস্থল, আশ্রয়স্থল।

৬। স্থানীয় কাজ, নিয়মিত বাহিনীর কাজ।

৭। প্রকাশ হয়ে পড়া কর্মী ও অপ্রকাশিত কর্মী।

৮। নেতৃস্থানীয় কর্মী রাখা না রাখা।

৯। বর্ষাকালীন আক্রমণ না শীতকালীন আত্মরক্ষা।

১০। শত্রুর ঘেরাও দমন আর আমাদের আত্মরক্ষার পদ্ধতি।

১১। আভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতকতা, জাতীয় শত্রুদের দ্বারা খবর প্রকাশ, শত্রুদের নিকট থেকে আমাদের খবর সংগ্রহ।

১২। অপারেশনে গেরিলা, অস্ত্র হারালে, শেল্টার প্রকাশিত হলে কি কি সমস্যা।

১৩। অপারেশনে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গেরিলা নিয়োগ বা এক অঞ্চল থেকে গেরিলা নিয়োগ।

১৪। নিয়মিত বাহিনী ও স্থানীয় কাজ।

১৫। স্থানীয় সামরিক কাজ ও অন্যান্য কাজ।

১৬। মতাদর্শগত কাজ, মানোন্নয়ন এবং সামরিক কাজ।

১৭। চিকিৎসার সমস্যা।

১৮। সকল আশ্রয়স্থল ব্যবহার করা বা কিছু রাখা।

১৯। অপারেশনে বর্তমান লাভ, ভবিষ্যত ক্ষতি বা বর্তমান ক্ষতি, ভবিষ্যত লাভ।

২০। আর্থিক লাভ না ক্ষতি, অস্ত্রের লাভ না ক্ষতি, জাতীয় শত্রু খতমে কি কি লাভ-ক্ষতি।

২১। উচ্চস্তর, সমস্তর ও নিম্নস্তরের সাথে যোগাযোগ থাকবে না ব্যাহত হবে।

২২। ক্যাম্প করে থাকা না বিচ্ছিন্ন থাকা।

২৩। এম্বুশ করা, কমান্ডো রেইড করা, না সম্মুখ আক্রমণ করা।

২৪। দিনে আক্রমণ না রাতে আক্রমণ। সন্ধ্যায়, গভীর রাতে না ভোর রাতে আক্রমণ।

২৫। অনুসন্ধান করে আক্রমণ না অনুসন্ধান ছাড়াই আক্রমণ।

২৬। প্রচণ্ড শত্রুচাপে টিকে থাকা না প্রত্যাহার।

২৭। অস্ত্রাদি রাখা না নিয়ে যাওয়া।

২৮। শ্রমবিভাগ করা না নিজে সব কাজ করা।

২৯। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সমস্যা।

৩০। অস্ত্র ও মূল্যবান সম্পদ দখল/সংগ্রহ/সংরক্ষণ এবং সামরিক কাজ।

৩১। প্রচার ও সামরিক কাজ।

৩২। সাংগঠনিক কাজ ও সামরিক কাজ।

৩৩। সার্বক্ষণিক নারীদের নেওয়া বা না নেওয়ার সমস্যা।

৩৪। সবাইকে সার্বক্ষণিক করা না কাউকে কাউকে অসার্বক্ষণিক রাখা।

সভায় নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়ঃ

○ সাব-সেকটর বহির্ভূত সামরিক এলাকা সরাসরি সেক্টর কমান্ডার কর্তৃক পরিচালিত হবে।

প্রয়োজনবোধে এ এলাকাকে অন্য Sub-Sector-এর অন্তর্ভূক্ত করা যাবে। অথবা বিকাশ করে

Sub-Sector করা হবে।

○ বিশেষ সামরিক অঞ্চলের পরিচালকের নিকট সেক্টর, সাব-সেক্টরের মানচিত্র পাঠাতে হবে।

মানচিত্রে নিম্নলিখিত চিহ্নগুলো থাকবেঃ

১। লাল—ভাল কাজ।

২। হলুদ—কিছু কিছু কাজ আছে।

৩। সবুজ—লক্ষ্যবস্তু।

৪। চিহ্ন থাকবেনা—কাজ নেই, লক্ষ্য নেই।

৫। বিকাশের লক্ষ্য।

৬। শত্রুর অবস্থান, প্রধান পথ, খাল।

মানচিত্র হাতে এঁকে তৈরী করতে হবে (না পাওয়া গেলে) গ্রাম পর্যন্ত। প্রত্যেক কমান্ডারের নিকট নিজ নিজ আওতাধীন ও যে এলাকার সাথে তার সমন্বয় হবে তার মানচিত্র থাকতে হবে।

○ উন্নতমানের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রথম প্রয়োজন।

দ্বিতীয় প্রয়োজন উন্নত প্রচার।

এরপর প্রয়োজন সংগঠন গড়ে তোলা।

চতুর্থ প্রয়োজন সশস্ত্র সংগ্রাম।

○ শত্রুকে ভীত সন্ত্রস্ত করার জন্যও ডামী (Dummy) অস্ত্র তৈরী করা।

○ প্রতিটি সাব-সেক্টরে মেডিক্যাল টিম (Medical team) এবং প্রাথমিক চিকিৎসা (First aid) শিক্ষা দেওয়া, সামরিক ও সাংগঠনিক কাজে অদক্ষ লোকদের নিয়ে মেডিক্যাল টিম করা এবং শেষ পর্যন্ত প্রতিটি গেরিলা গ্রুপে একজন করে বেয়ার ফুটেড (Bare-footed) ডাক্তার অন্তর্ভুক্ত করা।

○ ফিউজ নেই এরকম হ্যান্ড গ্রেনেড সংরক্ষণ করা এবং ব্যবহারবিধি উচ্চস্তর থেকে জেনে নেওয়া।

○ মাঝি এবং বিভিন্ন ধরণের নৌকার মাঝে কাজ গুরুত্বসহকারে বিকাশ করা। এজন্য বিশেষ লোক নিয়োগ করা।

○ লক্ষ্যবস্তুসমূহকে প্রকৃত নামে পরিচয় না দেওয়া। এগুলোর নামকরণ করে দেওয়া (যেমন x, y ইত্যাদি) ।

○ শত্রুর ছোটখাট ঘাঁটি দখলের জন্য কমান্ডো হামলার পদ্ধতি প্রয়োগ।

○ ক্ষতি হলেও যাতে কাজ বিঘ্নিত না হয় তার ব্যবস্থা রাখা। অর্থাৎ নির্ণায়ক ধরণের কাজ না করা।

○ স্থানীয় প্রশাসন (গ্রাম পরিচালনা কমিটি, ইউনিয়ন কমিটি এবং এর উপরিস্তর) ও গণসংগঠনগুলো (কৃষক মুক্তি, নারী মুক্তি, ছাত্র-যুব মুক্তি সমিতি ইত্যাদি) গড়ে তোলা।

○ ফ্রন্টের নামে সংগ্রাম চালানো এবং ফ্রন্ট কমিটিগুলো গড়ে তোলা।

○ বিশেষ সামরিক অঞ্চলের মধ্যে সাব-সেক্টর সমূহ অনুমোদিত হলো।

○ খাদ্য গ্রহণ, দাওয়াত গ্রহণ, আশ্রয়স্থলে থাকার বিষয়ে গেরিলাদের অতিশয় সতর্ক হতে হবে।

দাওয়াত খেয়ে এবং শত্রুর ফাঁদ পাতা আশ্রয়স্থলে আমাদের বহু গেরিলা ও ভাল কর্মী প্রাণ হারিয়েছে।

ঐক্য সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রেও খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

এক্ষেত্রে অসতর্ক হওয়ার ফলে আমাদের অনেক ভাল কর্মী প্রাণ হারিয়েছে।

○ সভার কাজ সাফল্যজনকভাবে শেষ হয়।

► ◄

পরিশিষ্ট ১

পূর্ববাংলার বর্তমান পরিস্থিতির উপর কতিপয় মন্তব্য

বাংলাদেশ পুতুল সরকার ও তার প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ বিরোধী প্রচণ্ড গণ অসন্তোষের সুযোগে পূর্ববাংলার কোন কোন স্থানে স্বতঃস্ফূর্ত বা কিছুটা সংগঠিত সশস্ত্র তৎপরতা চলছে।

জনগণের চেতনাকে ব্যবহার করার মত আমাদের নেতৃত্বে ব্যাপক সংগঠন ও সশস্ত্র সংগ্রাম না থাকার ফলেই এগুলো হচ্ছে। এটা আমাদের দুর্বলতারই প্রকাশ।

যারা এ ধরণের তৎপরতা চালাচ্ছে তাদের কেউ কেউ ‘মুসলিম বাংলার’ গেরিলা বলে দাবী করছে। এরা জাসদের কর্মী। এদের তৎপরতা ও ‘মুসলিম বাংলার’ বক্তব্য চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করছে জাসদ মার্কিনের দালাল।

পূর্ববাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের তৎপরতায় ঘাবড়াবার কোন কারণ নেই।

সরকার বিরোধী বিভিন্ন ধরনের তৎপরতা যত বৃদ্ধি পায়, পরিস্থিতি যত গরম ও ঘোলাটে হয়, আলোড়ন বৃদ্ধি পায় ততই আমাদের সুবিধা।

পঁচিশে মার্চের পরবর্তী সময় বিপ্লবের জন্য সুবিধাজনক অবস্থারই সৃষ্টি হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক সাহায্য ছাড়া ব্যক্তি, গ্রুপ, মুসলিম বাংলাওয়ালা জাসদ বা বুর্জোয়াদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, অসংগঠিত সশস্ত্র তৎপরতা টিকে থাকা বা বিজয় অর্জন করতে পারে না।

ভৌগলিকভাবে ভারত পরিবেষ্টিত পূর্ববাংলায় ভারতবিরোধী তৎপরতায় বৈদেশিক সাহায্য আসা প্রায় অসম্ভব।

কাজেই উপরোক্ত গ্রুপসমূহের সশস্ত্র তৎপরতা ব্যর্থ হতে বাধ্য।

অর্থাৎ পূর্ববাংলায় মুসলিম বাংলা, জাসদ বা বুর্জোয়াদের পক্ষে ভারত বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে ভারত ও তার দালালদের পরাজিত করে পূর্ববাংলার ক্ষমতা দখলের ভবিষ্যত অন্ধকার।

কাজের তাদের সৃষ্ট সশস্ত্র তৎপরতার ব্যর্থতার ফলে তাদের মধ্যকার দেশপ্রেমিকরা আমাদের সাথে যোগদান করবে।

কাজেই ক্ষমতা দখলের জন্য অন্য পথ গ্রহণ করা তাদের পক্ষে স্বাভাবিক। সে পথ হচ্ছে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের পথ।

ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের অংশ হিসেবে সশস্ত্র তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ পুতুল সরকার ও ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করা যাতে ভারত বাংলাদেশ একযোগে সোভিয়েটের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসে বা বাংলাদেশ ভারত-সোভিয়েটের প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে মার্কিনের তাবেদারে পরিণত হয় বা রাষ্ট্রক্ষমতায় মার্কিনীদের স্বার্থরক্ষাকারীদের ভাগ প্রদান করা হয়।

এর অর্থ হচ্ছে ভারত-পূর্ববাংলায় মার্কিনের শোষণ ও লুন্ঠন নিশ্চিত করা, সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ করা।

এ ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হতে পারে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বাধানো, বাংলাদেশে রায়ট, অভ্যুত্থান, সামরিক ক্যুদেতা ঘটানো।

এ সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত সফল হতে হলে পূর্ববাংলায় ভারতীয় তাবেদার বাহিনী বিশেষ করে রক্ষীবাহিনী ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে পরাজিত করতে হবে।

এর অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে ব্যাপক যুদ্ধ।

পঁচিশে মার্চের পরবর্তী অবস্থার মত পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি।

কাজেই ব্যাপক যুদ্ধ, রক্তপাত, গোলযোগ ব্যতীত মার্কিনের তাবেদারদের পূর্ববাংলায় ক্ষমতা দখল করা সম্ভব নয়।

এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হলে পূর্ববাংলার ব্যাপক অঞ্চলে আমাদের সশস্ত্র তৎপরতা জোরদার হবে, বিরাট অঞ্চল আমাদের দখলকৃত এলাকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।

পঁচিশে মার্চের সময় আমাদের ভাল প্রস্তুতি ছিলনা তবুও আমাদের বিরাট বিকাশ হয়। বর্তমানে আমাদের চমৎকার প্রস্তুতির কারণে অকল্পনীয় বিকাশ হবে।

মার্কিনীদের ষড়যন্ত্রের এটা হবে উৎকৃষ্ট জবাব।

ষড়যন্ত্রের অন্য পন্থা হতে পারে নিম্নরূপঃ

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নিক্সন-ব্রেজনেভ আলোচনার ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েট-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা আঁতাতে রূপ লাভ করতে পারে।

এর ফলস্বরূপ পূর্ববাংলা-ভারতে মার্কিন দালালদের রাষ্ট্রক্ষমতায় ভাগ লাভ, পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশ আঁতাতের সম্ভাবনা রয়েছে।

এ ধরণের পরিস্থিতিতে মার্কিনীদের সৃষ্ট সশস্ত্র তৎপরতার অবসান হবে, মার্কিনী দালালদের মুখোশ উন্মোচিত হবে। দেশপ্রেমিক জনগণ ও গেরিলারা তাদের ভাওতা বুঝতে পেরে সরে পড়বে।

তাদের অনেকেই সর্বহারা পার্টির সাথে যুক্ত হবে।

মার্কিন, ভারত ও সোভিয়েটের আঁতাত শত্রুজোটের ঐক্য ও শক্তি বাড়াবে সন্দেহ নেই কিন্তু পূর্ববাংলার সশস্ত্র বিপ্লবে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না, মুখোশধারী শত্রু থাকবে না। এক্ষত্রে আমাদের সুবিধা অর্জিত হবে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টিই আন্তর্জাতিক সাহায্য ব্যতিরেকেই জনগণের উপর নির্ভর করে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ববাংলাকে মুক্ত করতে সক্ষম।

কাজেই সাম্রাজ্যবাদের দালাল ব্যতীত অন্য যারাই সশস্ত্র তৎপরতা চালাক না কেন আজ হোক, কাল হোক তাদেরকে আমাদের সাথে আসতে হবে বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে হবে।

কাজেই আমাদেরকে সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যাপকভাবে শুরু করা এবং তাকে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। একইসাথে সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে এইরূপ বিভিন্ন গ্রুপের প্রকৃত চরিত্র বিশেষ করে মুসলিম বাংলাওয়ালাদের (জাসদ) মুখোশ উন্মোচন করা, আমাদের প্রতি তাদের শত্রুতামূলক তৎপরতা সম্পর্কে সতর্ক থাকা এবং আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া, তাদের মধ্যকার খাঁটি দেশপ্রেমিকদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

নোট

▬ মার্কিনীরা গণপ্রজাতন্ত্রী উত্তর ইয়েমেনের উৎখাতকৃত সামন্তবাদীদের দ্বারা সৌদি এরাবিয়ার মাধ্যমে সুদীর্ঘদিন সশস্ত্র তৎপরতা চালিয়েছে।

▬ ইরাকের কুর্দ উপজাতীয়দের দ্বারা ইরাক সরকার বিরোধী সশস্ত্র তৎপরতা চালিয়েছে; মার্কিনের নির্দেশে ইরান এ বিষয়ে সহায়তা করছে।

এ সকল ক্ষেত্রে মার্কিনের সহায়তার কারণে সশস্ত্র তৎপরতা চলছে। কিন্তু, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাইরে থেকে সহায়তা প্রদান করার মত সুযোগ মার্কিনের নেই (বার্মা বর্ডার ভারত কর্তৃক বন্ধ করা সম্ভব, সাগর থেকেও সাহায্য করা সম্ভব নয়)। কাজেই পূর্ববাংলায় সুদীর্ঘদিন মার্কিনের সশস্ত্র তৎপরতা পরিচালনা সম্ভব নয়।

পরিশিষ্ট ২

একটি এলাকায় কাজ করার সময় আমাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের খুঁজে বের করতে হবে, অতীতে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বর্তমানে মিত্র, ভবিষ্যতে প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে এদেরকেও খুঁজে বের করতে হবে।

এদের সাথে শত্রুদের সংযোগ হলে কি কি অবস্থার উদ্ভব হতে পারে তাও বিবেচনা করতে হবে।

প্রতিদ্বন্দ্বীদের মিত্রতার সম্পর্কে আনতে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

মিত্রতার সম্পর্কে এলে বা না এলে তারা যাতে কোন অবস্থাতেই (শত্রুর সাথে সংযোগ হোক আর না হোক) আমাদের স্বাধীনতা ও উদ্যোগ ব্যাহত করতে না পারে, ক্ষতি সাধন করতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।

কুদ্দুস মোল্লা, নিজাম প্রভৃতি আমাদের হাতের মুঠোয় ছিল। এরাই পরে শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়ে আমাদেরকে উৎখাত করে।

এ সম্ভাবনা চিন্তা করে এদের সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আমাদের ক্ষতি কম হতো।

সম্প্রতি ভোলার সিদ্দিক আমাদের উদ্যোগ ও স্বাধীনতা ব্যাহত করছে যদিও এক সময় সে আমাদের হাতের মুঠোয় ছিল।

ব্যাবস্থাসমূহঃ

▬ তাদের দ্বারা কি কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে তা বের করা।

▬ তাদের প্রকৃত চরিত্র তুলে ধরা।

▬ তাদের দ্বারা সৃষ্ট পরিস্থিতির মোকাবেলার ব্যবস্থা করা।

▬ তাদের মাঝে অনুপ্রবেশ করানো।

▬ গতিবিধির উপর নজর রাখা।

▬ বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ব্যবহার বা সৃষ্টি করা যাতে তারা মিত্রতায় না এলে উৎখাত হয়।

▬ তাদের উদ্দেশ্য ব্যাহত করা।

▬ তাদের ভেতরকার ঘৃণীতদের খতম করা