সিরাজ সিকদার রচনাঃ পূর্ববাংলা কি সোভিয়েটের উপনিবেশ, না ভারত-সোভিয়েট উভয়ের উপনিবেশ, না ভারতের উপনিবেশ—এ বিষয়ে হক-আমজাদ ও তোয়াহাদের নিকট কয়েকটি প্রশ্ন

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার


পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক রচনা ও প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ১৯৭৩। পার্টি কর্তৃক সংযোজনীসহ পুনপ্রকাশ অক্টোবর ১৯৭৩

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪


পিডিএফ

১। হক গ্রুপ ও আমজাদ গ্রুপ বলে পূর্ববাংলা সোভিয়েটের উপনিবেশ। ভারত তা তদারক করছে।

সকলেই জানেন, মনিসিং-সালাম কমিউনিস্ট পার্টি, মোজাফফর ন্যাপ প্রভৃতি হচ্ছে মস্কোপন্থী, অর্থাৎ, মস্কোর সবচাইতে বিশ্বস্ত দালাল। পূর্ববাংলার পুতুল সরকার এদের দ্বারা গঠিত না হয়ে গঠিত হয়েছে আওয়ামী লীগের দ্বারা। এই আওয়ামী লীগ কিছুদিন পূর্বেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালালী করেছে। বর্তমানেও এর এক অংশ (মার্কিনের) দালালী করছে। সোভিয়েটের উপনিবেশে তার বিশ্বস্ত দালাল মস্কোপন্থীদের দ্বারা পুতুল সরকার গঠিত না হয়ে গঠিত হলো আওয়ামী লীগের দ্বারা। ইহা কিভাবে সম্ভব?

২। কেউ কেউ বলতে পারেন আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়, তাই, তাদের দ্বারা সরকার গঠন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ জনপ্রিয় হলেও একজন মস্কোপন্থী মন্ত্রীও কেন গ্রহণ করা হলো না? প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য, মস্কোপন্থীরা সর্বদাই মন্ত্রীসভায় তাদের প্রতিনিধির দাবী করছে।

বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার জনপ্রিয়তা পুরোপুরি হারিয়েছে। এ অবস্থায় কেন সোভিয়েট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগকে সরিয়ে তার দালাল মস্কোপন্থীদের ক্ষমতায় বসায় না (পূর্ব ইউরোপের উপনিবেশগুলোতে যা সে প্রায়ই করে থাকে)?

৩। সম্প্রতি মস্কোপন্থীরা আওয়ামী লীগ প্রণীত সংবিধানে স্বাক্ষর করেনি, আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ চাচ্ছে, আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে। আওয়ামী লীগও পালটা তাদের পিটুনী দিচ্ছে।

এ সকল ঘটনাবলী কি প্রমাণ করে না যে, সোভিয়েট ইউনিয়ন তার দালাল মস্কোপন্থীদের দ্বারা পূর্ববাংলার ক্ষমতা দখল অথবা পূর্ববাংলার ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে? পূর্ববাংলা যদি সোভিয়েটের উপনিবেশই হতো তবে সোভিয়েটের অংগুলী হেলনেই পুতুল সরকার পরিবর্তিত হতো। ক্ষমতার জন্য মস্কোপন্থীদের আওয়ামী লীগের সাথে কামড়া-কামড়ি করতে হতো না (মার্কিনের উপনিবেশ ভিয়েতনামে মার্কিনের অঙ্গুলী হেলনেই পুতুল সরকার পরিবর্তিত হয়)।

৪। কেউ কেউ বলতে পারেন সোভিয়েটের উপনিবেশিক শোষণ মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। কাজেই তার পরিবর্তনের প্রয়োজন কি? আওয়ামী লীগ সোভিয়েটের উপনিবেশিক শোষণ মেনে নিলেও সোভিয়েট ইউনিয়ন তার বিশ্বস্ত ও নির্ভরশীল দালাল মস্কোপন্থীদেরকে কেন পুতুল সরকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করল না, অথবা আওয়ামী লীগ ও মস্কোপন্থীদের নিয়ে একটি সোভিয়েটের দালাল পার্টি তৈরী ও তাদের দ্বারা একটি নতুন পুতুল সরকার গঠন করল না?

বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মস্কোপন্থীদের নিয়ে তথাকথিত ‘গণসংহতি কমিটি’ গঠিত হয়েছে জনগণের মুক্তিসংগ্রাম দাবিয়ে রাখার জন্য।

অতীতে রাজাকার-আলবদর যেরূপ পাক সামরিক দস্যুদের দালালী করেছে তেমনি বর্তমানে মস্কোপন্থীরা আওয়ামী লীগের দালালী করছে। এ সকল তথাকথিত কমিটি এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতেই রয়েছে। মস্কোপন্থীরা এর ভাগ পায়নি। তারা আওয়ামী লীগের পুতুল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মাত্র।

৫। সোভিয়েটের উপনিবেশ পূর্ববাংলা, ভারত তা তদারকি করছে অর্থাৎ ভারত সোভিয়েটের নির্দেশে চলছে। এর অর্থ কি এ নয় যে ভারত সোভিয়েটের উপনিবেশে পরিণত হয়েছে? ভারত সরকার সোভিয়েটের পুতুল সরকার? কিন্তু প্রকৃত বিষয় হচ্ছে, ভারত একটি আধা-উপনিবেশিক দেশ। ভারত যদি সোভিয়েটের উপনিবেশ হতো তা হলে ভারতের মস্কোপন্থীরাই ভারতের সরকার গঠন করতো অথবা সরকারের অংশীদার হতো।

৬। জনাব তোয়াহা বলেন, পূর্ববাংলা ভারত-সোভিয়েটের উপনিবেশ।

একটি দেশ দুটি দেশের উপনিবেশ কীভাবে হতে পারে?

একটি দেশের দুটি অঞ্চল যদি দুই উপনিবেশিক শক্তির দখলে থাকে তাহলেই এটা হতে পারে। একটি উপনিবেশিক শক্তি কর্তৃক দখলকৃত অঞ্চলে বৈদেশিক শোষকরা লুন্ঠনের বখরা বসাতে পারে (অঞ্চল দখল না করেও)। যেমন, মার্কিনের উপনিবেশ ভিয়েতনামে জাপানী সাম্রাজ্যবাদীরা লুন্ঠনের বখরা বসিয়েছে। কাজেই পূর্ববাংলা একই সাথে দুই শক্তির উপনিবেশ হতে পারে না। একটি শক্তির উপনিবেশ পূর্ববাংলায় অন্য শক্তি লুন্ঠনের বখরা নিচ্ছে।

৭। পূর্ববাংলা ভারত-সোভিয়েট উভয়ের উপনিবেশ হলে বাংলাদেশ পুতুল সরকারকে অবশ্যই উভয়ের নিকট দায়ী থাকতে হবে। একটি সরকার একইসাথে দুই উপনিবেশিক শক্তির নিকট কীভাবে দায়ী থাকে?

৮। পূর্ববাংলা ভারত ও সোভিয়েটের উপনিবেশ। ভারত হচ্ছে একটি আধা-উপনিবেশিক আধা-সামন্তবাদী দেশ। এই আধা-উপনিবেশিক, আধা-সামন্তবাদী দেশের উপনিবেশ হচ্ছে পূর্ববাংলা। জনাব তোয়াহার বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, আধা-উপনিবেশিক, আধা-সামন্তবাদী দেশের উপনিবেশ থাকতে পারে। এভাবে জনাব তোয়াহা তার অতীত বক্তব্য “আধা-সামন্তবাদী, আধা-উপনিবেশিক দেশের উপনিবেশ থাকতে পারে না”—কে খণ্ডন করেছেন।

৯। বাংলাদেশ ভারত ও সোভিয়েট উভয়ের উপনিবেশ—প্রমাণ করে ভারত ও সোভিয়েট ইউনিয়ন সমপর্যায়ের দেশ। অর্থাৎ, ভারতও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী দেশ। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে—ভারত একটি আধা-উপনিবেশিক, আধা-সামন্তবাদী দেশ। একে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সমপর্যায়ভুক্ত করা হচ্ছে চরমতম ভুল।

১০। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, একইসাথে দুটি দ্বন্দ্ব প্রধান হতে পারেনা; একটি প্রধান হবে, অপরটি গৌণ হবে। কাজেই ভারত সোভিয়েট উভয়েই প্রধান দ্বন্দ্ব, প্রধান শত্রু বা উভয়েরই উপনিবেশ পূর্ববাংলা হতে পারে না।

অবশই একটি প্রধান দ্বন্দ্ব, একটি প্রধান শত্রু এবং পূর্ববাংলা একটি দেশের উপনিবেশ হবে। কাজেই “পূর্ববাংলা ভারত-সোভিয়েট উভয়ের উপনিবেশ, উভয়ের সাথে পূর্ববাংলার জনগণের দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব, উভয়ে পূর্ববাংলার জনগণের প্রধান শত্রু”—এ বক্তব্য মার্কসবাদ পরিপন্থী।

১১। উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, পূর্ববাংলা সোভিয়েতের উপনিবেশ—এ বক্তব্য ভুল; পূর্ববাংলা ভারত ও সোভিয়েট উভয়ের উপনিবেশ—এ বক্তব্যও ভুল।

প্রকৃতপক্ষে পূর্ববাংলা হচ্ছে ভারতের উপনিবেশ যেখানে সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীরা লুটের ভাগ বসিয়েছে।

সংযোজনী

সম্প্রতি তোয়াহারা তাদের বক্তব্য (“পূর্ববাংলা ভারত-সোভিয়েটের উপনিবেশ”) পালটিয়ে বলছেন, “পূর্ববাংলা সোভিয়েটের নয়া উপনিবেশ এবং ভারতের আশ্রিত রাজ্য।”

নয়া উপনিবেশবাদ ও তার কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে লি-ডুয়ান মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভিয়েতনামী জনগণের সুদীর্ঘ দিনের সংগ্রামের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করতে যেয়ে বলেন, “নয়া উপনিবেশবাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নয়া-উপনিবেশে সাম্রাজ্যবাদীরা সরাসরি প্রশাসন ব্যবস্থা চালায়না। এর পরিবর্তে তারা দেশীয়দের দ্বারা সরকার পরিচালনা করে। এ দেশীয়রা সামন্তবাদ ও দেশীয় বুর্জোয়ার (Comprador Bourgeois) স্বার্থরক্ষা করে এবং একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক বেশ নেয়।” (Le Duan—The Vietnamese Revolution; Fundamental Problems and Essential Tasks, Page-24) উপরোক্ত ভিয়েতনামী অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় পূর্ববাংলাকে সোভিয়েটের নয়া উপনিবেশ বলতে বুঝায়, পূর্ববাংলা সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের এমন উপনিবেশ যা তারা নিয়ন্ত্রণ করছে আদের তাবেদার আওয়ামী লীগ পুতুল সরকারের মাধ্যমে (নিজেরা নয়)।

পূর্ববাংলার বাস্তব অবস্থা প্রমাণ করছে, পূর্ববাংলা সোভিয়েটের নয়া উপনিবেশ নয় বা বাংলাদেশ সরকার সোভিয়েট নিয়ন্ত্রিত পুতুল সরকার নয়। সিকিম, ভূটান ভারতের আশ্রিত রাজ্য। সাম্প্রতিককালের সিকিমের ঘটনা প্রমাণ করছে আশ্রিত রাজ্যের স্বাধীন সত্তা নেই। সিকিম ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীন।

উপরে বর্ণিত আশ্রিত রাজ্যসমূহের সরকার হচ্ছে ভারতের নিয়ন্ত্রিত পুতুল সরকার। এ নিয়ন্ত্রণ থেকে আশ্রিত রাজ্যসমূহ মুক্তি চায়। স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চায়।

এখানে দেখা যায়, পূর্ববাংলাকে ভারতের আশ্রিত রাজ্য বললে বুঝায় পূর্ববাংলা ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীন দেশ এবং বাংলাদেশ সরকার ভারতের নিয়ন্ত্রিত পুতুল সরকার।

উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, পূর্ববাংলাকে একই সময়ে সোভিয়েটের নয়া উপনিবেশ এবং ভারতের আশ্রিত রাজ্য বললে বুঝায় পূর্ববাংলা একই সময়ে সোভিয়েটেরও নিয়ন্ত্রিত, ভারতেরও নিয়ন্ত্রিত; বাংলাদেশ সরকার একই সময়ে সোভিয়েট ও ভারত উভয়েরই নিয়ন্ত্রিত পুতুল সরকার। স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে, একটি দেশ একই সময়ে দুটো দেশের দ্বারা উপনিবেশের অনুরূপ নিয়ন্ত্রিত এবং একটি সরকার একই সাথে দুটো দেশের পুতুল সরকার কীভাবে হয়?

সোভিয়েটের নয়া-উপনিবেশ হিসেবে প্রধান দ্বন্দ্ব এবং প্রধান সংগ্রাম সোভিয়েটের বিরুদ্ধে, আবার আশ্রিত রাজ্য হিসেবে প্রধান দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম ভারতের বিরুদ্ধে।

এ থেকে দেখা যায়, তোয়াহা সাহেবের বক্তব্য মতে দুই দ্বন্দ্ব ও দুই শত্রু প্রধান হয়।

তোয়াহা সাহেবের এ বক্তব্য মার্কসবাদের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও রাষ্ট্র সংক্রান্ত তত্ত্বসমূহের সাথে পুরোপুরি অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ভুল। পূর্ববাংলা একই সাথে সোভিয়েটের নয়া-উপনিবেশ এবং ভারতের আশ্রিত রাজ্য হতে পারে না।

প্রকৃতপক্ষে পূর্ববাংলা হচ্ছে ভারতের উপনিবেশ যেখানে সোভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের শোষণ বর্তমান।

কমরেড সিরাজ সিকদার—জিন্দাবাদ!

পূর্ববাংলার সর্বহারারা—ঐক্যবদ্ধ হোন।

পূর্ববাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করুন।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি—জিন্দাবাদ