সিরাজ সিকদার রচনাঃ শহর ও গ্রামে বাস্তব সামরিক অপারেশনের কতিপয় কৌশলগত দিক

সিরাজ সিকদার

সিরাজ সিকদার


পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক রচনা ও প্রকাশ ডিসেম্বর ১৯৭২

কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী বাংলাদেশ কর্তৃক সর্বহারা পথ (www.sarbaharapath.com) এর অনলাইন প্রকাশনা ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪


 

পিডিএফ

 অপারেশন পূর্বেকার দায়িত্ব

১। অনুসন্ধানঃ

অনুসন্ধানের সফলতার উপর অপারেশনের সাফল্য, কর্মীদের নিরাপত্তা অনেকখানি নির্ভর করে।

অনুসন্ধান ভুল বা অসম্পূর্ণ হলে পরিকল্পনা ঠিক হবে না। অপারেশন কার্যকরী করার প্রাক্কালে কর্মীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, অপারেশন ব্যর্থ হতে পারে।

০ সাধারণতঃ জাতীয় শত্রু ও অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুর তালিকা আমাদের কর্মী ও সহানুভূতিশীলরা তথ্যসহ প্রেরণ করে।

কখনো ব্যক্তিগত শত্রুতা এবং অল্প অপরাধ বা আদৌ জাতীয় শত্রু নয় এরূপ ব্যক্তিও শত্রু তালিকাভূক্ত হয়ে যেতে পারে।

অনুসন্ধানের অন্যতম লক্ষ্য হবে প্রকৃতই জাতীয় শত্রু বা তাদের প্রতিষ্ঠান কিনা তা কঠোরভাবে যাচাই করা।

০ প্রাথমিক অনসন্ধান আমাদের সাধারণ অবস্থার আলোকে করতে হবে। এমন লক্ষ্যবস্তু অনুসন্ধান করে সময় নষ্ট করা উচিৎ নয় যা আমাদের ক্ষমতার বাইরে।

০ প্রাথমিক অনুসন্ধান সম্পন্ন হলে লক্ষ্যবস্তু সমূহ আমাদের বাস্তব অবস্থার আলোকে পর্যালোচনা করা।

এর ভিত্তিতে লক্ষ্য স্থির করা।

০ চূড়ান্ত অনুসন্ধান করা।

এ ক্ষেত্রে একাধিক কমরেড দ্বারা অনুসন্ধান করানো, তাদেরকে ম্যাপসহ পরিকল্পনা পেশ করতে বলা। ম্যাপে অপারেশন লক্ষ্যবস্তুর স্থানটিসহ সবকিছু এবং আশেপাশের অবস্থা, আসা ও চলে যাওয়ার পথসমূহ থাকবে।

০ অনুসন্ধানের ভিত্তিতে লক্ষ্যবস্তু অনুমোদন করা।

০ অপারেশন করার আগমুহুর্ত পর্যন্ত অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া যাতে লক্ষ্যবস্তুর কোন পরিবর্তন শেষ মুহুর্তে বিবেচনা করা যায়।

২। পরিকল্পনাঃ

অনুসন্ধান ও নিম্নলিখিত সমস্যার ভিত্তিতে পরিকল্পনা করা।

গেরিলাদের সংখ্যা, অস্ত্র, গেরিলাদের অবস্থান, যাতায়াত নির্ধারণ করা।

তারিখ, সময় নির্ধারণ করা।

৩। অস্ত্র সংগ্রহ ও সরবরাহঃ

অস্ত্র বহন করা ও পৌঁছে দেওয়া বা তৈরী করার কাজে সম্ভাবনায়ময় কর্মী, গেরিলা নিয়োগ না করা।

অস্ত্র তৈরী করতে যেয়ে সম্ভাবনাময় ও গুরুত্বপূর্ণ কমরেড শাহীন নিহত হয়।

অস্ত্র অনেক সময় অপারেশনের আগের দিন গেরিলাদের দেওয়া হয় বা অপারেশনের পূর্বে দেওয়া হয়।

অপারেশনের পরে অস্ত্র নিয়ে নেওয়া হয়। দেওয়া ও নেওয়ার সময় অস্ত্র ও গোলাবারুদের হিসেব রাখা যাতে কোনকিছুরই অপব্যবহার না হয়।

অনির্ভরশীল লোকের নিকট অস্ত্র না রাখা। এ ধরণের লোকের নিকট অস্ত্র রাখায় এরা অস্ত্র কয়েক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করেছে। কয়েক ক্ষেত্রে অস্ত্র খোয়া গেছে।

অস্ত্র যারা রাখবে ও সরবরাহ করবে তারা খুবই নির্ভরশীল ও দায়িত্ব জ্ঞান সম্পন্ন কমরেড হবে। তারা যেভাবেই হোক অস্ত্র রক্ষা করবে।

৪। গেরিলা সংগ্রহঃ

০ সম্ভাবনাময় কর্মী যথাসম্ভব না নেওয়া।

০ ধরা পড়লে বা নিহত হলে এলাকার সামগ্রিক কাজে ক্ষতি হবে এমন কমরেডদের না নেওয়া।

০ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিযুক্ত কমরেডদের না নেওয়া।

০ ভ্রষ্টদের ও সন্দেহজনক ব্যক্তিদের অপারেশনে যথাসম্ভব কম নেওয়া।

০ অর্থনৈতিক অপারেশনে, শত্রুর অর্থ ও মূল্যবান দ্রব্যাদি দখল করার দায়িত্ব ভ্রষ্টদের উপর না দেওয়া।

০ বিশ্বস্ত, শৃংখলা ও নির্দেশ পালন করে, আত্মবলিদানে উদ্বুদ্ধদের নেওয়া।

০ কমান্ডার, সহকারী কমান্ডার নিয়োগ করা।

০ রাজনৈতিক কমিশার নিয়োগ করা।

০ কুরিয়ার নিয়োগ করা যে ট্রুপের খবরাখবর পরিচালক/কমিশারের নিকট দেবে। ওয়াকিটকি বা ওয়্যারলেস এর নিকট থাকবে।

০ গেরিলাদের অবস্থান, দায়িত্ব ও অস্ত্র নির্ণয়।

৫। অপারেশনে গেরিলা নিয়োগের পূর্বে সম্ভাব্য সকল পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে নেওয়াঃ

০ সময় মত আসে কিনা তা যাচাই করার জন্য পরীক্ষামূলকভাবে একত্রিত করা।

০ অস্ত্রের দায়িত্বে নিযুক্ত কমরেড সময়মত আসে কিনা তা দেখা।

০ সম্ভব হলে মেকী অপারেশনের ব্যবস্থা করা এবং গেরিলাদের যাচাই করা।

০ মৌখিকভাবে প্রশ্ন করা ও দেখা।

০ অতীতের কার্যাবলী সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করা।

০ অতীতের সামরিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করা।

৬। যথাসম্ভব কম গেরিলা নিয়ে অপারেশন ট্রুপ গঠন করা। বেশী গেরিলা নিয়ে ট্রুপ গঠন করলে তা পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও চলে আসার মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। শহরের ট্রুপ অবশ্যই ছোট হবে।

গেরিলাদের একত্রিত হওয়াঃ

০ একত্রিত হওয়ার স্থান ও সময় নির্ণয়।

০ গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য একত্রিত হওয়ার স্থান না জানিয়ে এক একজনকে পৃথক পৃথকভাবে বিভিন্ন স্থানে প্রোগ্রাম দিয়ে মিলন স্থানে নিয়ে আসা।

০ মিলন স্থান, বৈঠকের স্থান এমন জায়গায় হলে ভালো হয় যা প্রকাশ হয়ে পড়লেও কোন ক্ষতি হবে না।

এ কারণে কর্মী বা সহানুভুতিশীলদের বাসা না হলে ভাল হয়।

০ সময়মত গেরিলারা একত্র হবে, অস্ত্র সরবরাহ করতে হবে এবং যানবাহন প্রস্তুত করতে হবে।

এ সকল কাজে দায়িত্বপূর্ণ কমরেড নিয়োগ করতে হবে।

৮। পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় অপারেশনে অংশগ্রহণকারী গেরিলাদের নিয়ে বসলে ভাল হয়। এর ফলে তাদের মতামত ও প্রস্তাব পাওয়া যায়।

পরিকল্পনা ভালভাবে গেরিলাদের বুঝিয়ে দেওয়া।

তাদের দায়িত্ব ভালভাবে বুঝিয়ে দেওয়া।

৯। অপারশনের দুর্ঘটনাসমূহঃ

০ অপারেশনের ব্যর্থতার ফলে উদ্ভূত সমস্যা পর্যালোচনা করা।

০ ধরা পড়লে কি কি করতে হবে তা ঠিক করে দেওয়া।

০ আহতদের নিয়ে আসা, রাখা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করে রাখা।

০ নিহতদের নিয়ে আসা ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করে রাখা।

০ গ্রেফতারকৃতদের সাথে যোগাযোগ করা ও মুক্ত করা এবং গ্রেফতারের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত সমস্যাবলী সমাধানের ব্যবস্থা রাখা।

০ আহত, নিহত, গ্রেফতারকৃতদের পরিবারে সাহায্যের ব্যবস্থা বিবেচনা।

০ আহত, নিহত ও গ্রেফতারকৃতদের কারণে উদ্ভূত সমস্যাবলীর সমাধান বিবেচনা করা।

১০। অপারেশনের সময়সীমাঃ

অপারেশনের সময়সীমা নির্ধারণ করা অর্থাৎ কত সময়ব্যাপী অপারেশন চলবে তা নির্ধারণ করা।

বিশেষ করে শহরে এ ধরণের সময়সীমা অবশ্যই কয়েক মিনিটের বেশী হবেনা, অন্যথায় বিপদে পড়তে হবে।

বিদ্যুৎ বেগে অপারেশন করে চলে আসতে হবে। কোন মতেই অপারেশন প্রলম্বিত করা চলবেনা।

১১। অনুমতিঃ

আঞ্চলিক নেতা/পরিচালকের লিখিত অনুমতি ব্যতিত কোন অপারেশন হবে না।

লিখিত সার্কুলার দিয়ে ইহা কর্মীদের জানিয়ে দেওয়া এবং কঠোরভাবে এ নিয়ম কার্যকরী করা।

কারণ—

০ ব্যক্তিগত স্বার্থে অপারেশন হতে পারে।

০ শত্রু-মিত্র নির্ণয় না করেই হামলা হতে পারে।

০ যথাযথ অনুসন্ধান, পরিকল্পনা না হওয়ায় অস্ত্র ও কর্মী খোয়া যেতে পারে।

০ অস্ত্র ও মূল্যবান দ্রব্যাদি আত্মসাৎ করতেপারে।

০ পার্টির সুনাম নষ্ট হতে পারে। জনগণের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে।

১২। শত্রুর সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ, আমাদের গেরিলাদের সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ, জনগণের সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ, প্রকৃতির সম্ভাব্য সকল পরিবর্তন চিন্তা করে বের করা এবং গেরিলাদের তা বুঝিয়ে দেওয়া, কি কি করতে হবে তা বাতলে দেওয়া।

সকল সম্ভাবনা চিন্তা না করার ফলে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে।

০ সম্ভব হলে অপারেশনের রিহার্সেল করা।

১৩। শহরে আক্রমণের জন্য পিস্তল ব্যবহার করা যায়।(ঠিক মতো গুলি বেরোয় এবং ভাল সই হয়)। গ্রামে আত্মরক্ষার্থে রিভালবার ব্যবহার করা যায়।

১৪। শহরে অপারেশন করার সময় এমনভাবে করা যাতে বাইরের লোক টের না পায়।

১৫। দখলকৃত দ্রব্যাদির একাধিক স্থান পরিবর্তনের ব্যবস্থা করা।

১৬। অপারেশনের পূর্বে গাড়ী ও অন্যান্য যানবাহনের নাম্বার প্লেট পাল্টানো। চালক চালিয়ে দেখাবে যাতে সে যানবাহনের নিয়মবিধি বোঝে।

জ্বালানী পূর্ণ করে নেয়া।

১৭। প্রাকৃতিক অবস্থার বিবেচনাঃ

দিন বা রাত, দিন রাতের কোন সময়, অন্ধকার রাত না চাঁদনী রাত, বৃষ্টি না শুকনা, কোন অবস্থা
অপারেশনের জন্য ভাল তা বিবেচনা করা।

১৮। অর্থনৈতিকঃ

বাজারের উঠানামা, অর্থের যাতায়াত ভালভাবে লক্ষ্য করা।

১৯। অস্ত্রঃ

০ প্রত্যেককে অস্ত্রের ব্যবহার শিখিয়ে দেওয়া।

০ অস্ত্র, গোলাবারুদ ঠিকঠাক আছে কিনা তা দেখে নেওয়া।

০ একাধিক অস্ত্র নেওয়া যাতে একটা বিকল হলে সচল অস্ত্র থাকে।

২০। অবস্থানঃ

০ অপারেশনে গেরিলাদের অবস্থানের ত্রুটির জন্য শত্রু পালাতে পারে।

০ নিজেদের কর্মীর ক্ষতি হতে পারে।

০ অপারেশন ব্যর্থ হতে পারে।

০ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে গুরুত্বপূর্ণ লোক দেওয়া।

২১। নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা প্রসঙ্গেঃ

০ অপ্রয়োজনীয়ভাবে এক ট্রুপ অন্য ট্রুপকে না চেনানো।

০ অপারেশনের তারিখ, সময় পূর্বাহ্নে না জানানো। গেরিলাদের নির্দিষ্ট দিনে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হয়ে আসতে বলা।

০ গেরিলাদের পরস্পরের বাড়ী না চেনানো। পরিচালক কুরিয়ারের মাধ্যমে গেরিলাদের একত্রিত করবে।

০ অপারেশন বিষয়ক কোন তথ্য অপারেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ প্রকাশ করবে না।

০ নিরাপত্তার কারণে কোন কোন অপারেশনের লক্ষ্যবস্তু গেরিলাদের না জানানো, অপারেশনের পূর্বক্ষণে জানানো।

০ অপারেশন ব্যর্থ হয়েছে বা গেরিলাদের জানানো হয়েছে অথচ অপারেশন হয়নি এরূপ লক্ষ্যবস্তুতে বহুদিন পর অপারেশন করা যায়।

২২। গ্রামে বা শহরে অনেক সময় ভয় দেখানোর জন্য শব্দ করতে হয়। এক্ষেত্রে বাজী ব্যবহার করা যায়।

২৩। শহরে পরিকল্পিতভাবে গাড়ী ড্রাইভার, বেবীটেক্সী ড্রাইভার সংগ্রহ করা, রিকসা, ঠেলা, গরুর গাড়ী চালক, ঘোড়ার গাড়ী চালক, ট্রাক, বাস ড্রাইভারও যোগাড় করা উচিত। কর্মীদের তা চালাতে শিখানো।

এভাবে শহরে যানবাহনের সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা।

জেলে, নৌকা মাঝি, লঞ্চ, জাহাজ শ্রমিকদের মাঝে কাজ করা উচিত, আন্তঃজেলা যানবাহনের সমস্যার সমাধানের জন্য।

২৪। নতুনদের অভিজ্ঞ করে তোলার জন্য তাদেরকে কম গুরত্বপূর্ণ ও সহজ অপারেশন ও অবস্থানে নিয়োগ করা। অভিজ্ঞদের সাথে নতুনদের নিয়োগ করা।

২৫। একই অপারেশনে পরস্পর বৈর ভাবাপন্ন কর্মী ব্যবহার না করা।

২৬। গেরিলাদের কারো কারো মাঝে হামবড়াভাব, সমরবাদ দেখা দিতে পারে, শৃংখলা, নির্দেশ পালনে ঢিলে দিতে পারে।

শিক্ষার মাধ্যমে এগুলো দূর করার প্রচেষ্টা চালানো।

অসংশোধিতদের যথাযথ শাস্তি বিধান করা।

শৃংখলা লংঘনকারীদের যথাযথ শাস্তি প্রদান।

২৭। অপারেশন ট্রুপের জন্য বিশেষ রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত ক্লাশের ব্যবস্থা করা যাতে তারা আত্মবলিদানে উদ্বুদ্ধ হয়, শৃংখলা ও নির্দেশ পালনে আদর্শ হয়, গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা বজায় রাখে।

২৮। অপারেশনকালে কমান্ডার নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে, তা কমান্ডারকে বুঝিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ কর্মীদের বাঁচামরা, অপারেশনের সাফল্য তার উপর নির্ভরশীল—এ গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে তাকে সচেতন করা।

০ কমান্ডারদের জন্য বিশেষ ক্লাশ নেওয়া, তাদের পরিবর্তনশীল অবস্থা বিশ্লেষণ করে সমাধান বের করতে শেখানো।

০ গেরিলাদের থেকে কমান্ডার হতে যোগ্য এরূপ গেরিলা প্রতিনিয়ত বের করা।

০ কমান্ডার হতে পারে এরূপ কর্মীদের অনুশীলনে দক্ষ করে তোলা।

০ ব্যক্তি বিশেষের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে না পড়া।

০ অপারেশনে যথাযথ কমান্ডার ঠিক করা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ এবং অপারেশনের জন্য নির্ণায়ক।

২৯। অপারেশনের জন্য গেরিলা যথাযথভাবে সংগৃহীত না হলে অপারেশনের ব্যর্থতা এবং কর্মীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।

৩০। বিশেষ অবস্থার মোকাবেলার জন্য কমান্ডো ট্রুপ, বিশেষ ট্রুপ গঠন করা যায়। ক্রমে ক্রমে সার্বক্ষণিক ট্রুপ গঠন করা উচিত।

চক্রবিরোধী সংগ্রামের সময় বিশেষ ট্রুপ গঠন করা হয়েছিল। অস্থায়ীভাবে এরা সার্বক্ষণিক ছিল এবং একস্থানে থাকত।

গেরিলাদের বাসস্থান চেনে এরূপ দু’জন কমরেড পালাক্রমে তথ্যকেন্দ্রে চব্বিশ ঘন্টা থাকত। চক্রের সংবাদদাতারা তথ্যকেন্দ্রে খবর দিত। এরা চক্রের সম্ভাব্য যাতায়াতস্থান, বাসস্থান ও মিলনস্থানের আশেপাশে অবস্থান করতো। চক্রের দেখা পেলে সঙ্গে সঙ্গে এসে তথ্যকেন্দ্রে রিপোর্ট করতো।

তথ্যকেন্দ্রের কমরেড তৎক্ষণাৎ গেরিলাদের উক্ত খবর সরবরাহকারীর সাথে সংযোগ করে দিত।

এভাবে অতি অল্প সময়ের মাঝে গেরিলারা হামলাস্থলে উপস্থিত হতে পারত এবং অপারেশন চালাতে পারত।

চক্ররা মানুষ, তাই সচল এবং সতর্ক। কাজেই তাদেরকে মোকাবেলার জন্য উপরোক্ত পদ্ধতি খুবই সুবিধাজনক ছিল।

এ বিশেষ ট্রুপের প্রয়োজনীয়তা শেষ হলে তা ভেঙ্গে দেওয়া হয়।

এ পদ্ধতি অন্যান্য অবস্থায়ও ব্যবহার করা যায়।

৩১। কমান্ডো ট্রুপঃ

ট্রুপ সদস্যগণ অসার্বক্ষণিক হতে পারেন। এদেরকে ছোট অস্ত্র দিয়ে একাধিক লক্ষ্যবস্তু ঠিক করে অপারেশনের দায়িত্ব দিতে হবে।

তারা সুবিধামত অপারেশন করে রিপোর্ট করবে।

৩২। পরিচালক/নেতা নিম্নলিখিত বিষয়ের সময়মত সমন্বয় সাধন করবেনঃ

০ গেরিলাদের সমাবেশ।

০ অস্ত্রের ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ের সরবরাহ।

০ যাতায়াত ব্যবস্থার সমাবেশ।

০ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনুসন্ধানকারীর রিপোর্ট।

এ সকল বিষয়ের সময়মত ও যথাযথ সমন্বয় না হলে অপারেশন সম্ভব হবে না। যেমন—গেরিলারা এলো, কমান্ডার এলো না বা সব গেরিলা এলো না, অস্ত্র এলো না বা দেরী করে এলো, সবকিছুই সমাবেশ হলো কিন্তু যানবাহন এলো না বা শেষে অনুসন্ধানের খবর এলো না, এমন অবস্থায় অপারেশন বাতিল হয়।

০ উপরোক্ত বিষয়সমূহ সময়মত ও যথাযথ সমন্বয় করে অপারেশনের শেষ ও চূড়ান্ত অনুমতি প্রদান করা এবং ট্রুপকে অপারেশনে পাঠানো।

০ উপরোক্ত বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন হলেও অপারেশন করা যায় কিনা তা ভালভাবে বিবেচনা না করে অপারেশন বাতিল না করা।

দু’জন গেরিলা আসেনি বলে একটি অপারেশন প্রথমবার বাতিল করা হয়। এদের ছাড়াও অপারেশন করা সম্ভব ছিল।

পরের বার ঐ দু’জন বাদেই অপারেশন করা হয়। কিন্তু পূর্বদিন অপারেশন বাতিল না হলে আমরা চল্লিশ হাজার টাকা অধিক পেতাম।

অপারেশনকালীন দায়িত্ব

১। অপারেশন লক্ষ্যবস্তুর কোন পরিবর্তন দেখে অপারেশন করা হবে কি হবে না তা বিবেচনা করার সমস্যা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গেই ট্রুপ প্রত্যাহার করে চলে আসা।

সন্দেহজনক ঘোরাফেরা, আলাপ-আলোচনা, দেরী করা উচিত নয়। কারণ অস্ত্রশস্ত্র প্রকাশ হয়ে যেতে পারে, লোকজনের মনে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে, শত্রু খবর পেয়ে যেতে পারে। ফলে সমগ্র ট্রুপই বিপদে পড়তে পারে।

সম্প্রতি এ কারণেই একটি ট্রুপ বিপদে পড়ে, অস্ত্র ও কর্মী খোয়া যায়।

শহরে ইহা কঠোরভাবে পরিহার করতে হবে।

২। গেরিলারা পরিকল্পনা মোতাবেক অবস্থান নিয়েছে, অপারেশন লক্ষ্যবস্তুও মোটামুটি পরিকল্পনামত হয়েছে দেখে অপারেশন শুরুর সংকেত প্রদান করা।

৩। অপারেশন শুরুর ও শেষের জন্য সংকেত প্রদান করা। ইহা মুখে বা বাঁশির সাহায্যে দেয়া যায়। কখনো গ্রামে গুলির সাহায্যে দেয়া যায়।

সময়মতো সংকেত বা নির্দেশ না দিলেঃ

▬ শত্রু হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।

▬ শত্রু আক্রমণ করতে পারে।

▬ কর্মী খোয়া যেতে পারে।

▬ অপারেশন ব্যর্থ হতে পারে।

অনেক অপারেশনের ব্যর্থতা এ কারণে হয়।

৪। অপারেশনকালে পরিস্থিতির পরিবর্তন অনুযায়ী ট্রুপ ও গেরিলাদের নির্দেশ দিতে হবে।

৫। অপারেশনকালে জাতীয় শত্রুর বাড়ী তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান করতে হবে। জাতীয় শত্রু পালিয়ে থাকতে পারে, তার সম্পদ লুকিয়ে রাখতে পারে।

৬। গ্রামে পার্টি ও নেতৃত্বের নামে শ্লোগান প্রদান, সম্ভব হলে জনগণকে একত্রিত করে বক্তৃতা প্রদান করা যায়।

৭। আত্মরক্ষার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। এর জন্য ৬নং পয়েন্ট গ্রহন করা যায় কারণ জনগণ আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল; তাই আমাদের বাঁধা দেবে না।

৮। অপারেশন পরিকল্পনা কার্যকরী করা।

৯। কমান্ডার অপারেশনকালে নির্দেশ প্রদান ও অন্যান্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে সহকারী কমান্ডার নির্দেশ প্রদান ও অন্যান্য দায়িত্ব পালন করবে।

সহকারী কমান্ডারও ব্যর্থ হলে গেরিলাদের যে কেউ কমান্ডারের দায়িত্ব নিজ উদ্যোগে পালন করতে পারে।

১০। সম্ভব হলে পরিচালক একজন অনুসন্ধানকারী রেখে অপারেশন পর্যবেক্ষণ করাবে।

১১। ওয়াকিটকি বা ওয়্যারল্যাস থাকলে ট্রুপের কুরিয়ার অপারেশনের ধারাবিবরণী, সমস্যা, কমান্ডারের বক্তব্য পরিচালকের নিকট জানাবে এবং পরিচালক যথাযথ নির্দেশ পাঠাবে।

অপারেশন পরবর্তীকালীন দায়িত্ব

১। অপারেশন শেষে চলে আসা—

▬ প্রত্যেকের চলে আসার পথ ঠিক করে দেওয়া।

▬ চলে আসার কালে সম্ভাব্য পরিস্থিতি ও তার সমাধান বাতলে দেওয়া।

চলে আসার কালের ভূলের জন্য অনেক কমরেড ধরা পড়েছে।

২। দখলকৃত দ্রব্যাদি ও অস্ত্রাদি নির্দিষ্ট স্থানে ও সময়ে জমা দেওয়া।

তালিকা ও সম্ভব হলে স্বাক্ষরসহ জমা নেওয়া।

দখলকৃত দ্রব্যাদির স্থান পরিবর্তন।

৩। সনাক্ত করা যায় এরূপ দখলকৃত জিনিসপত্র নিয়ে বাইরে চলাফেরা না করা।

অপারেশনে ব্যবহৃত যানবাহনে বাইরে না ঘোরা।

৪। আহত/মৃতদের সমস্যার সমাধান।

০ গ্রেফতারকৃতদের সমস্যার সমাধান।

০ অভিজ্ঞতার সারসংকলন।

০ উচ্চস্তরে মূল্যবান দ্রব্যাদি, রিপোর্ট ও সারসংকলন পাঠানো।

৫। প্রচার করা।

উপসংহার

একটি অপারেশন জটিল কাজ, বহু বিষয়ের যথাযথ সমন্বয় প্রয়োজন। অপারেশনের মাধ্যমে এর নিয়মবিধি জানতে হবে এবং অধিকতর সফলতার সাথে অপারেশন করতে হবে।

কমান্ডার, গেরিলাগণ সাহসী ও বিচক্ষণ হবেন, সৃজনশীলভাবে অপারেশন সংক্রান্ত সমস্যাবলীর সমাধান করবেন। অপারেশনসমূহ সফলতার সাথে করবেন, ক্রমে ক্রমে জটিলতর অপারেশন করার যোগ্যতা অর্জন করবেন।

পরিশিষ্ট-২

জাতীয় শত্রু

০ জনগণ কর্তৃক ঘৃণীত ছয় পাহাড়ের দালাল সরকারের চোখ-কান।

০ পার্টি-জনগণ বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত জনগণঘৃণীত প্রতিক্রিয়াশীল।

০ অমার্জনীয় অপরাধ করেছে এরূপ সরকারী/আধাসরকারী, সামরিক/আধাসামরিক কর্মচারী।

০ জনগণ কর্তৃক ঘৃণীত ডাকাত, লুটেরা, খুনী, দাঙ্গাকারী।

০ পাক দস্যুদের প্রাক্তন দালাল যারা জনগণ কর্তৃক ঘৃণীত এবং বর্তমানেও অত্যাচারী।

০ দলত্যাগী ও বহিষ্কৃতদের মাঝে বিশ্বাসঘাতক, পার্টি, বিপ্লব, জনগণ বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত বৈর ব্যক্তি।

০ প্রকাশ্য/গোপন শত্রুচর।

০ সরকারী-আধাসরকারী সম্পদও জাতীয় শত্রু সম্পদ বলে পরিগণিত হবে