সিপিএমএলএম ফ্রান্সঃ গনসালোর পরিস্থিতি সম্পর্কে [২৬ জুন ২০১৪]

সিপিএমএলএম ফ্রান্সঃ

২৬ জুন ২০১৪

গনসালোর পরিস্থিতি সম্পর্কে

১৯৯২ সালে গনসালো নামে বিখ্যাত এবিমেল গুজম্যান গ্রেফতার হওয়ার সময় থেকে তাঁর ব্যাপারে সাম্রাজ্যবাদের সুসংহত প্রতিক্রিয়া-তৎপরতা লক্ষ্যনীয়। তাঁর সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য যা যা করা দরকার যে কোন মূল্যে সবই করা হয়েছে তাঁর ভাবধারা কোনভাবেই যাতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। আমরা এখানে সেই পরিস্থিতির একটি ব্যাখ্যা সকলের সামনে হাজির করছি।

১। ক) গনসালো শত্রুদের হাতে বন্দী আছেন

যখন একজন কমিউনিস্ট কারাগারে থাকেন, তিনি তখন শত্রুর হাতে বন্দী থাকেন,তার সম্পর্কে নানা মিথ্যা ছড়ানোসহ ও সকল সম্ভাব্য উপায় শত্রু পক্ষ তার নিজস্ব প্রতিক্রিয়াশীল প্রচেস্টায় ব্যবহার করতে gonzalo-dossপারে। উদাহরন হিসাবে আমরা ১৯৭০ সালের শেষ দিকের কথা মনে করতে পারি। সেই সময়ে সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিম জার্মানী লাল ফৌজ দল (রোতে আর্মি ফ্র্যাকশন) এর অনেক সদস্যদের ‘আত্মহত্যা’রএকটি কল্প কাহিনী প্রচার করেছিলো।

তাই, স্বাভাবিক ভাবে, আমরা কোন কমরেডের মতাবস্থান জানতে সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভর করতে পারিনা। এমন কি যদি জনতার সামনে হাজির করাও হয়, তাকেও শঠতাপূর্ণ সন্দেহ করতে হবে, যেমন, তারা আমাদের কমরেডকে মাদকাষক্ত করে থাকতে পারে। আমরা যদি প্রতিবিপ্লবের প্রতি আন্তরিক সমর্থন না দেখি অথবা বিপরীতে প্রতিক্রিয়ার সাথে একটা সংঘাত না দেখি, তাহলে পরিস্থিতি ভালভাবে বোঝা সম্ভব নয়।

১। খ) গ্রেফতার হবার পর মাত্র দুইবার গনসালোকে প্রকাশ্যে দেখা গেছে

বুর্জোয়ারা না ভাবতে চাইলেও তারা কৌশলগত কারনে কিছু বষয় বুঝতে পারে এবং তা থেকে তারা শিক্ষা গ্রহন করে। বিশেষ করে, বলিভিয়ায় ১৯৬৭ সালে আর্নেস্তো “চে” গুয়েভারাকে গ্রেফতার করার পর তাঁকে খুন করা ভুল হয়েছিলো বলে বুর্জোয়ার মনে করে কারণ পরবর্তীতে এই ঘটনাকে সশস্ত্র সংশোধনবাদীরা তাকে কেন্দ্র করে একটি শ্রদ্বাবাদ গড়ে তুলতে কাজে লাগায়।

অতএব, প্রথম প্রতিক্রিয়া হিসাবে, তারা ১৯৯২ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর গনসালোকে একটি খাচায় পুড়ে সাদা কালোর ডোরাকাটা কয়েদি পোষাক পড়িয়ে তাকে জনসম্মুখে হাজির করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো কমরেড গনসালোকে একজন বোকা মানুষ হিসাবে দেখানো, কিন্তু তিনি গণমাধ্যমের সামনে গর্জে উঠলেন আর একটি বিখ্যাত বক্তব্য রাখলেন। তিনি গনযুদ্ধকে অনুসরন ও এগিয়ে নেয়ার আহবান জানালেন এবং পথের সকল বাঁধা অতিক্রমের ডাক দিলেন।

এর ফল সাম্রাজ্যবাদিদের জন্য মোটেই সুখকর হয়নি,এবং এর পর কমরেড গনসালোকে মাত্র একবারই জনসম্মুখে দেখানো হয়েছিল। তারিখটা ছিলো ৫ই নভেম্বর ২০০৪ সাল। গণমাধ্যমের সামনে, বিচারকদের উদ্দেশ্য গনসালো পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে দাঁড়ালেন এবং ব্যাঘ্র গর্জনে পেরুর কমিউনিস্ট পার্টি ও সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে শ্লোগান দিলেন, আর তখনই মাইক্রোফোন বন্ধ করে দেয়া হয়, তারপর আর প্রেস কোনভাবেই আর কিছু প্রচার করতে পারেনি।

২। ক) “শান্তি পত্রসমূহ”

কমিউনিস্ট দৃষ্টি ভংগী থেকে, এখন আমরা কমরেড গনসালোর অবস্থা সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি কিছুই নিশ্চিত ভাবে বলতে পারব না । যা চাউর আছে তা একেবারেই গুজব, প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তা-ই সুনির্দিস্ট ভাবে চাইছেঃ সন্দ্বহের উদ্রেগ করা, গুজব ছড়ানো এবং বিশ্বাসঘাতকতা।

১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে, পেরুর রাষ্ট্রপতি আলবার্তো ফুজিমোরি কমরেড গনসালোর লেখা বলে কথিত একটি পত্র পড়ে শোনায়। 43অতপর একের পর এক দলিল প্রকাশিত হয়,যাতে দেখানো হয় পেরুর কমিউনিস্ট পার্টির অনেক ক্যাডার ও গনসালোর স্বাক্ষর করা আছে, সেখানে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানানো হয়েছে,তবে এর ধরন পালটাতে বলা হয়, যার অর্থ দাঁড়ায় সশস্ত্র সংগ্রাম ত্যাগ করে শান্তি চুক্তির জন্য সংগ্রাম করা।

সেটা কারাগারে নির্দেশনার দ্বারা কয়েক দফা সংলাপের মাধ্যমে “রণনৈতিক” বোঝাপড়ার ফলাফল হতে পারে। একে কোনভাবেই পলায়ন হিসেবে তুলে ধরা হয়নি বরং নতুন পরিস্থিতে একটি উলম্ফন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

২। খ) “শান্তি পত্রগুলোর” চরিত্র

এই সমস্যাটি সহজেই বোধগম্যঃ এই শান্তি চুক্তির আহবানের সাথে আমরা যদি গনসালোর মাত্র এক বছর আগে জনগণের উদ্দেশ্যে দেয়া বক্তব্য মিলাই তবে তা আমাদের নিকট এর অর্থ পরিস্কার হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এটা গনসালোর বিগত দশকে দেয়া ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে যায়।

একটি কেন্দ্রীয় দিক হলো আধা-সামন্তবাদ বিষয়কে প্রধান বিষয় হিসেবে অথবা বাস্তব জিনিস হিসেবে নেতিকরণ করা (বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের সিপিএমএলএম পার্টিরসাধারণ দলিলে এই বিষয়টিকে সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে)। যেমন নেপালে, আত্মসমর্পনের পথ বেছে নিয়ে বিশ্বাসঘাতক লাইন বলতে লাগলো যে দেশীয় শ্রেণী স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থে রূপান্তর করা হয়েছে দেশকে “আধুনিকীকরন” করার নিমিত্তে। আধা সামন্তবাদকে নেতিকরণ করা হলো “আধুনিকীকরন”কে ন্যায্যতা দেবার জন্য, যেমনটা হোজাবাদিরাও করে থাকে।

আন্তর্জাতিক বুর্জোয়ারা ও পেরুভিয়ানশাসকরা যা চেয়েছে এটা আবশ্যিকভাবে তার সাথে মিলে যায়, তারা “আলোকোজ্জ্বল পথ” কেএকটি অপরাধী ও নির্মম সংগঠন হিসাবে প্রমান করার জন্য তাদের সকল প্রচার মাধ্যমকে কাজে লাগিয়েছে আর দিবানিশি মিথ্যা দুর্নাম রাটিয়েছে।

৩। ক) পেরুতে এই কথিত “শান্তি পত্রসমূহের” প্রতিক্রিয়া

পেরুতে সেই সময়ে আবির্ভুত হল আরওএল, একটা ডান সুবিধাবাদী লাইন, যা “শান্তি পত্রসমূহ”কে সমর্থন দিল; এর পর আভির্ভাব ঘটল একটি বাম সুবিধাবাদী লাইনের, এবং আইনী একটি দলের, এমওভিএডিইএফ, যা মাত্র কিছু দিন আগেও নিপিড়িত ছিলো।

এখানে একটা মজার বিষয় লক্ষ্যনীয়, চীনের মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় দেখা গিয়েছিলো যা এখানেও সেই একই পরিস্থিতিঃ দক্ষিনপন্থীরা নেতাকে ঊর্ধ্বে তুলা ধরার ভাণ করে,বামপন্থীরা নেতাকে অতিক্রম করে যায় কারণ নেতা নাকি তার নিজ লাইনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।

প্রকৃত কমিউনিস্টরা খুবই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন এবং এখনও তারা বেশ কঠিন পরিস্থিতি অতিক্রম করে চলেছেন যেখানে নির্দিষ্টত মেরিয়েতেগুইর সাথে যুক্ত পেরুর বিপ্লবী পথ হিসেবে তার জাতীয় বৈশিষ্ট্যে গনসালো চিন্তাধারাকে প্রতিক্রিয়াশীলদের ও তাদের মিত্রদের ঘোরতোর আক্রমণ মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

৩। খ) আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে শান্তি পত্রের প্রতিক্রিয়া

আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে, পেরুর গণযুদ্ধের প্রতি যে সমর্থন সম্প্রসারিত হচ্ছিলো, তা কার্যত স্থবির হয়ে পরে। বিদেশে কাজ করার জন্য পেরুর কমিউনিস্ট পার্টি সৃষ্ট যে পেরুর গণ আন্দোলন (এমপিপি) এ অগ্নিশিখাকে প্রজ্বলিত রেখেছিল, এমন কি তাদের মধ্যেও নানা প্রকার বিভক্তি দেখা দিলঃ দক্ষিনপন্থী (যেমনজার্মানী ও ফ্রান্সে) এবং বামপন্থী ( সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্সে) হিসেবে ভাগ হয়ে পড়ল।

অনেকেই, নির্দিষ্টতঃ আমেরিকার বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি বলতে লাগল এর পেছনে (শান্তি লাইন – সর্বহারা পথ) নাকি কমরেড গনসালো আছেন, একটি ভয়ংকর ও নীরব ষড়যন্ত্ রগনসালোর চিন্তাধারাকে এবং তার শিক্ষাকে নেতিকরণ করে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে যেভাবেই হোক জয়ী হয়েছিল।

৪। ক) এমপিপির অবস্থান

এমপিপি নিবিড়ভাবে কাজ করছিলো তুরস্কের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) এবং ইতালির রসোপেরো (যা ইতালির মাওবাদি কমিউনিস্ট পার্টিতে পরিণত হয়)র সাথে, যারা অতঃপর এমপিপি ও গনসালোকে ত্যাগ করল নেপালের গণযুদ্ধকে সমর্থনের জন্য, তারপর এরা এটা ধ্বংস হওয়ার দীর্ঘ সময় পর ভারতীয় পার্টির প্রতি সমর্থনে মোড় নেয়।

এমপিপি ক্রমেই অধিক থেকে অধিক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে; ২০১৩ সালে সে কুয়েডরের কমিউনিস্ট পার্টি—পুনর্গঠন কমিটির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছিলো, কিন্তু সেই নতুন সংগঠনটির তখনই সমাপ্তি ঘটে যায়। এখানে বেশি গুরুত্বপুর্ন বিষয় হলো, এমপিপি চিন্তাধারাকে এগিয়ে নেয়নি।

সিপিএমএলএম ফ্রান্সের মতে এটা এসেছে লাইন ও অংশ (দল) সম্পর্কে এর বিভ্রান্তি থেকে।

৪। খ) চিন্তাধারাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা

চিন্তাধারা প্রশ্নটিকে এগিয়ে নেয়ার কাজটা করেছে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, বেলজিয়াম এবং ফ্রান্সের সংগঠনসমূহ “বিপ্লবের পথনির্দেশক চিন্তাধারাঃ মাওবাদের মর্ম” শীর্ষক একযৌথ দলিল প্রকাশ করে, যাতে রয়েছে পথনির্দেশক চিন্তাধারাকে যারা বহন করেছেন সেসকল ব্যক্তিকে নিয়ে প্রশ্নোত্তর।

এই উপলব্ধি সম্ভব হয়েছে গনসালোর চিন্তাধারার আন্তর্জাতিক তাৎপর্যের ওপর গভীর কাজ করার ফলে। তাঁর চিন্তাধারায় দুটি দিক রয়েছেঃ একটি জাতীয় দিক আর অন্যটি আন্তর্জাতিক দিক। প্রত্যেক চিন্তাধারার দুটি দিক রয়েছে।

সিপিএমএলএমবাংলাদেশ সম্প্রতি এ বিষয়ে যথার্থ বক্তব্য রেখেছেঃ

“পথনির্দেশক চিন্তাধারা একটা নির্দিষ্ট দেশের সাথে যুক্ত। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট পথনির্দেশক চিন্তাধারার অনেক দিকই সার্বজনীনভাবে প্রযোজ্য হতে পারে। যেমন, কমরেড সিরাজ সিকদার বলেছেন যে আধা উপনিবেশের উপনিবেশ থাকতে পারে। এটা সার্বজনীনভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু কমরেড সিরাজ সিকদারের সব তত্ত্বই সার্বজনীনভাবে প্রযোজ্যpenseeguide নয়। এই প্রেক্ষিতে, গনসালো চিন্তাধারা সভাপতি মাওয়ের পর সবচেয়ে অগ্রসর। এটা মাওবাদ সুত্র এবং গণযুদ্ধের তত্ত্বকে সংজ্ঞায়িত করেছে। কিন্তু এখনো আমরা বলছিনা যে সমগ্র গনসালো চিন্তাধারা সার্বজনীনভাবে প্রযোজ্য। একইসাথে, গনসালো চিন্তাধারা অথবা যেকোন চিন্তাধারা নিজেকে বাদ-এ বিকশিত করতে পারে।”

তাই, গনসালোর পরিস্থিতি পেরুর কমরেডদের জন্য একটা কেন্দ্রীয় ভাবনার বিষয়, কেননা এটা তাদের নিজেদেরপথনির্দেশক চিন্তাধারার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে এটাগৌনকারণতাদের নিজস্ব পথনির্দেশক চিন্তাধারা রয়েছে, যা তাদের প্রধান দিক। এমন কি যদি তাকে অত্যাবশ্যকীয় হিসাবে কেউ বিবেচনা করে, তবে তার মর্মবস্তু হবে গনসালো চিন্তাধারার সার্বজনীন দিক সমুহ।

(কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী ফ্রান্স এর ওয়েবসাইট lesmaterialistes.com থেকে সর্বহারা পথ বাংলা অনুবাদ করেছে। গনসালোর পরিস্থিতি এর চেয়ে ভালভাবে আর কোন দলিলে বর্ণিত হয়নি)